নিষিদ্ধপল্লির গাঙ্গুবাই

নিষিদ্ধপল্লির গাঙ্গুবাই

 মুম্বইয়ের কুখ্যাত নিষিদ্ধপল্লি কামাথিপুরা। একসময় বলা হত, সেখানে নাকি কখনও অমাবস্যার হয় না। কারণ সেখানে থাকেন গাঙ্গুবাই। যে চরিত্রে পর্দায় আসছেন আলিয়া ভাট। সোনালি পাড়ের সাদা শাড়ি, কপালে বড় লাল টিপ। চোখা সংলাপ। শরীরী ভাষায় স্পষ্ট যে, শুধু বণিতা নন, একজন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেত্রীকেই পর্দা ফুটিয়ে তোলেছেন অভিনেত্রী। তা কে এই গাঙ্গুবাই? কেনই বা তাকে নিয়ে ছবি করলেন সঞ্জয় লীলা বনশালি।

গাঙ্গুবাইয়ের জীবনের গল্প। মায়ানগরীতে এসে কত স্বপ্নই তো হারিয়ে যায়। দু-চোখে যৌথজীবনের স্বপ্ন নিয়ে এ নগরীতে এসে, তেমন করেই অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল একটি মেয়ে। তখন তার কতই বা বয়স। পনেরো ষোলো হবে। যে-ছেলেটির হাত ধরে গুজরাট থেকে মায়ানগরীতে পালিয়ে এসেছিল, সে তার বাবার হিসাবপত্তর দেখাশোনার কাজ করত।

সেই ভরসার হাত দুটোই একদিন তাঁকে একটা অন্ধকার নিষিদ্ধপল্লিতে দাঁড় করিয়ে রেখে চলে গিয়েছিল অকস্মাৎ। এমন বিশ্বাস আর স্বপ্নভাঙার গল্প বোধহয় কম নেই এই দুনিয়ায়। কিন্তু তফাৎ একটাই। তাঁরা সবাই গাঙ্গুবাই নন। কারণ গাঙ্গুবাই হয়ে ওঠা মুখের কথা নয়। নিজের স্বামী যাকে যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেয়, সেরকম অসহায় একটি মেয়ে থেকে মুম্বইয়ের ত্রাস হয়ে ওঠা গাঙ্গুবাই- এই পথচলা সহজ ছিল না কখনোই।

সঞ্জয় লীলা বনশালি এই মেয়েটির অর্থাৎ গাঙ্গুবাইয়ের জীবনকেই তুলে এনেছেন পর্দায়। গাঙ্গুবাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করছেন আলিয়া ভাট। ট্রেলার মুক্তি পেতেই হইচই পড়ে গিয়েছে সিনেপ্রেমীদের। কেন একজন বারবণিতার জীবনকে সিনেমায় আনলেন পরিচালক? তার উত্তর পেতে ফিরে দেখতে হবে সেই জীবনটিকেই।  মেয়েটির আসল নাম ছিল গঙ্গা হরজীবনদাস।

ছোট থেকেই ছিল সিনেমাজগতে পা রাখার স্বপ্ন। কলেজে পড়াকালীন জীবনে আসে প্রেম। সেই প্রেমই মেয়েটিকে পথে বসিয়েছিল। মাত্র পাঁচশো টাকায় মুম্বইয়ের এক নিষিদ্ধপল্লিতে বিক্রি হয়ে যায় গঙ্গা। সৌজন্যে তার প্রেমিক তথা স্বামী। এক লহমায় পালটে গেল জীবনটা। নিষিদ্ধপল্লি কামাথিপুরায় এসে গঙ্গা হয়ে উঠলেন গাঙ্গুবাই। গোড়ার আড়ষ্টতা কাটল কিছুদিনের মধ্যেই। একসময় কামাথিপুরায় সকলের মুখে মুখে ঘুরত একটাই নাম – গাঙ্গুবাই। সেটা ছয়ের দশকের মুম্বই। সেসময় কামাথিপুরার ত্রাস ছিল করিম লালা।

কুখ্যাত মাফিয়া, যার নামে বলতে গেলে কাঁপত গোটা মুম্বই। হাজি মস্তান ও বরদারাজন, এই দুজন ছিল তার দুইহাত। তাদের নিয়েই শাসন চালাত করিম লালা। এই করিম লালার কাছেই সুবিচারের আশায় একবার ছুটে গিয়েছিলেন গাঙ্গু। করিমের দলের কোনও এক সদস্য গাঙ্গুকে যৌনহেনস্তা করেছে। বিহিত চাই তাঁর, তাই সোজা করিম লালার কাছে নালিশ ঠুকেছিলেন গাঙ্গু।

তবে সেখানে গিয়ে শুরু হল অন্য রূপকথা। গাঙ্গুকে বোনের মর্যাদা দিয়েছিল করিম লালা। শুধু তাই নয়, কামাতিপুরার রাজত্বও সঁপেছিল গাঙ্গুর হাতে। সেই শুরু। গাঙ্গু ক্রমে হয়ে উঠলেন মাফিয়া কুইন। ওই নিষিদ্ধপল্লি তো বটেই, মুম্বইয়ের গোটা এলাকাই একসময় কাঁপত গাঙ্গুবাইয়ের নামে। নিষিদ্ধপল্লির ব্যবসা থেকে ভাল টাকাপয়সাও রোজগার করেছেন গাঙ্গু। সে সময় একটা দামি গাড়ির মালিকও ছিলেন তিনি। তবে অর্থ বা ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি কোনওদিনই।

করিম ও গাঙ্গুবাইয়ের আমলে কোনও মেয়েকে অনিচ্ছাসত্ত্বে যৌনপল্লিতে নামতে হয়নি। বরং যৌনকর্মীদের জীবনের উন্নয়নের দিকে মন দিয়েছিলেন গাঙ্গু। যৌনকর্মীদের সন্তানেরা যাতে পড়াশোনার সুযোগ পায়, সেদিকেও নজর ছিল তাঁর। কামাথিপুরায় গাঙ্গু ক্রমে হয়ে উঠেছিলেন সকলের মা।  মুম্বইয়ের ওই এলাকা থেকে যৌনপল্লিটি তুলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বেশ কয়েক বার। সে সময় যৌনকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছেন গাঙ্গু। এমনকি যৌনকর্মীদের অধিকারের দাবিতে তিনি চলে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছেও।

গাঙ্গুর বিচক্ষণতা ভাল লেগেছিল নেহরুর। সে যাত্রায় বেঁচে যায় কামাথিপুরা। গাঙ্গুবাইয়ের অবদান আজও মনে রেখেছে মুম্বইয়ের ওই এলাকা। সেখানে তাঁর মূর্তিও বসানো হয়েছে। শোনা যায়, এখনও নিষিদ্ধপল্লির দেওয়ালে জ্বলজ্বল করে গাঙ্গুর ছবি। ডাকসাইটে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেত্রী, অথচ কামাথিপুরার যৌনকর্মীদের কাছে তিনি অভিভাবক। বুক দিয়ে আগলেছেন নিষিদ্ধপল্লির বাসিন্দাদের। একটা গোটা জীবন যেন হয়ে উঠেছে লার্জার দ্যান লাইফ। আর এমন জীবনকে সিনেমা ছুঁয়ে দেখবে না, তা কী করে হয়! যে মায়ানগরীতে এসে অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল গাঙ্গু, সেই মায়ানগরী তো বটেই গোটা দেশই সিনেমাহলের অন্ধকারে বসে দেখবে গাঙ্গুবাইয়ের জীবনের কাহিনি – সে জীবন শুধু অন্ধকারের নয়, আলোরও।