অষ্ট মহাদ্বাদশী ব্রত মাহাত্ম্য

অষ্ট মহাদ্বাদশী ব্রত মাহাত্ম্য

একাদশী সম্পূর্ণ হয়ে পরের দিন দ্বাদশীতে কলামাত্র বৃদ্ধি পেলে অথচ দ্বাদশীর পরের দিন বৃদ্ধি না পেলে তাকে উন্মীলনী দ্বাদশী বলা হয়। এরকম হলে দ্বাদশী তিথিতে উপবাস করে ত্রয়োদশীতে পারণ করতে হবে। পদ্মপুরাণে এই মহাদ্বাদশীর মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। একসময় অম্বরীশ মহারাজের রাজভবনে গৌতম মুনি উপস্থিত হলে, রাজা প্রফুল্লচিত্তে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন- হে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ! কর্মবন্ধন মোচন ও বৈকুন্ঠগতি লাভ হয়, এমন কোন বৈষ্ণব ব্রতের কৃথা কৃপা করে আমাকে উপদেশ করুন।

উত্তরে গৌতম ঋষি বললেন- হে রাজন! পূর্বে ভগবান শ্রীবিষ্ণু আমার ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে স্বয়ং উন্মীলনী ব্রতের উপদেশ করেছিলেন। সেই ব্রত কথা এখন আপনার কাছে বলছি। ত্রিভুবনের সকল তীর্থ, যজ্ঞ, বেদ ও তপস্যা এই ব্রতের কোটি অংশের এক অংশের সমান নয়। যে মাসে উন্মীলনী তিথির আবির্ভাব হয়, সেই মাসে ভগবানের নাম উচ্চারণ করে যথাবিধি মধুসূদনের পূজা করতে হবে। হে দেবেশ! হে পুর্ণ্যকীর্তি আপনাকে প্রণাম। আমাকে শোকমোহ ও মহাপাপরূপ সংসার সাগর থেকে উদ্ধার করুন।

আমি শতজন্মে কিঞ্চিৎ পুণ্যও করিনি। তবুও হে জগন্নাথ! আমাকে ভবসাগর থেকে উদ্ধার করুন। আপনার প্রতি অহৈতুকী ভক্তি প্রদান করুন। কৃপা করে আমার নিবেদিত এই অর্ঘ্য গ্রহণ করুন। এইভাবে অর্ঘ্য প্রদান করে নৈবেদ্য, স্তব-স্তুতি, আরতি-কীর্তনে ভগবানের প্রীতিসাধন করতে হয়। এইভাবে অনুষ্ঠিত ব্রতের প্রভাবে ব্রতকারী ধনবান, বিদ্বান, দীর্ঘায়ু, ও পুত্রবান হন। ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে বলা হয়েছে যে, এই ব্রতে দান, হোম প্রভৃতি সবই অক্ষয় হয়ে থাকে। এই ব্রত অনুষ্ঠান না করা হলে মানুষকে যমযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।

ব্যঞ্জুলী মহাদ্বাদশী   সূর্যোদয় থেকে আরম্ভ করে একাদশী পূর্ণ হলে এবং দ্বাদশীও পূর্ণ হয়ে তার পরের দিন ত্রয়োদশীতে কিছু অংশ থাকলে ঐ দ্বাদশীকে ‘ব্যঞ্জুলী’ বলা হয়। এক্ষেত্রে একাদশী না করে ঐ দ্বাদশীতেই উপবাস করতে হবে। পরের দিন দ্বাদশীর মধ্যেই পারণ করতে হবে। ত্রয়োদশীতে পারণ নিষেধ। পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে এই দ্বাদশী ব্রত শ্রীহরির অত্যন্ত প্রিয়। একটি অশ্বমেধ যজ্ঞ এক হাজার অগ্নিষ্টোম থেকে শ্রেষ্ঠ।

আবার একটি বাজপেয় এক হাজার অশ্বমেধ থেকে আরও বেশী শ্রেষ্ঠ। একটি পুন্ডরীক এক হাজার বাজপেয় থেকে অধিক ফলবিশিষ্ট। একটি সৌত্রামণি সহস্র পুন্ডরীক থেকে শ্রেষ্ঠ। একটি রাজসূয় এক হাজার সৌত্রামণির চাইতেও শ্রেষ্ঠ। কিন্তু একটি ব্যঞ্জুলী ব্রত সহস্র রাজসূয় অপেক্ষাও অধিকতর শ্রেষ্ঠ। কলিকালে ‘ব্যঞ্জুলী’ এই শব্দ উচ্চারণ মাত্রই শতসহস্র জন্মের পাপক্ষয় হয়ে যায়।

শ্রীগুরুদেব খুশি হলে শ্রীহরিও প্রীত হন। অতএব এই তিথিতে শ্রীহরির প্রীতির জন্য শ্রদ্ধাসহকারে গুরুদেবের পূজা করতে হবে। রাত্রি জাগরণ করে কৃষ্ণকথা শ্রবণ করতে হবে। গীতা, বিষ্ণু সহস্র নাম ও শ্রীমদ্ভাগবত যত্নসহকারে পাঠ করা কর্তব্য। নৃত্য, গীত ও সংকীর্তনে শ্রীহরি পরম সন্তুষ্ট হন। এই ব্রত অনুষ্ঠানে সর্বতীর্থে স্নান ও সমস্ত প্রকার দানের ফল লাভ হয়। পূর্ব জন্মার্জিত পর্বত প্রমাণ পাপরাশি এই ব্রত পালনে অচিরেই বিনষ্ট হয়।

ত্রিস্পৃশা মহাদ্বাদশী প্রথমে একাদশী তারপর সমস্ত দিন দ্বাদশী এবং রাত্রিশেষে ত্রয়োদশী হলে তা ‘ত্রিস্পৃশা’ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। শ্রীহরির বিশেষ প্রিয় এই মহাপূণ্য তিথিতে সযত্নে উপবাস করা কর্তব্য। এই ব্রতের পারণ ত্রয়োদশীতে করতে হয়। পদ্মপুরাণে শ্রীসনৎকুমার-বেদব্যাস সংবাদে এই ব্রতের মহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। সনৎ কুমার বললেন- সর্বপাপবিনাশিনী এই ত্রিস্পৃশা মহাব্রত সকলেরই পালন করা উচিত।

চক্রধারী ভগবান বিষ্ণু ক্ষীরসমুদ্রে শিব, ব্রহ্মা ও আমার কাছে এই ব্রত সম্পর্কে বলেছিলেন। জড় বিষয়ে অত্যন্ত আসক্ত ব্যক্তিও যদি এই ব্রত পালন করে, তবে তারা মুক্তিলাভের যোগ্য হয়। হে মুনিবর! বারাণসীতে ও প্রয়াগে মৃত্যু হলে এবং গোমতীতে স্নান করলে মানুষের মুক্তি লাভ হয়। একসময় শ্রীজাহ্নবী ভগবান মাধবের কাছে এসে বললেন- হে হৃষীকেশ! কলিযুগের মহাপাপী মানুষ যখন আমার জলে স্নান করবে, সেই পাপে আমি কলুষিত হয়ে পড়ব।

এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? শ্রীমাধব বললেন- হে গঙ্গে! সর্বকলুষ বিনাশী এই ত্রিস্পৃশা ব্রত তুমি পালন কর। ভগবানের নির্দেশে গঙ্গাদেবী এই ত্রিস্পৃশা ব্রত পালন করে কলির কলুষ থেকে মুক্ত হন। হে মুনিবর! বিষয় অনুরাগী ব্যক্তি কিংবা বিষয় অনাসক্ত, উভয়ের পক্ষে মুক্তি লাভ করা কঠিন। তাই মুক্তিদানকারী এই ত্রিস্পৃশা ব্রতের অনুষ্ঠান করা কর্তব্য।

পক্ষবর্ধিনী মহাদ্বাদশী  অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমা সম্পূর্ণ হয়ে প্রতিপদে কিছুমাত্র থাকলে তার পূর্বের দ্বাদশী তিথির নাম ‘পক্ষবর্ধিনী’। এই অবস্থায় একাদশীর দিন উপবাস না করে দ্বাদশীতেই উপবাস করতে হয়। অনন্ত কলুষ বিনাশকারী এই দ্বাদশী পরিত্যাগকারীকে বহু বছর নরকে বাস করতে হয়। যে মাসে পক্ষবর্ধিনী হয়, শ্রীহরির সেই মাসের নাম অনুসারে তাঁকে ভক্তিসহকারে পূজা করতে হয়।   ‘হে জগন্নাথ! আপনি এই সংসার সমুদ্রের নৌকাস্বরূপ পাপরূপ তৃণের জন্য মহা অনল, নরক অগ্নির প্রশমনকারী, জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধির মোচনকারী।

তাই ভবসাগরে পতিত আমাকে আপনি কৃপা করে উদ্ধার করুন। হে পত্মনাভ। আমার নিবেদন এই অর্ঘ্য গ্রহণ করুন। আপনাকে আমি প্রাণাম জানাই।’ এইভাবে শ্রীহরিকে অর্ঘ্য নিবেদন করে নৈবেদ্য ও সুস্বাদু ফলমূল অর্পণ করতে হয়। নিজ সামর্থ মতো যত্ন সহকারে শ্রীহরির গুণকীর্তন ও রাত্রিজাগরণে এই ব্রত পালন করতে হয়। এই ব্রত পালনে দশ হাজার অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়ে থাকে। 

সংসারার্ণবপোতায় পাপকক্ষামহানল।
নরকাগ্নিপ্রশমন জন্মমৃত্যুজরাপহ।।
মামুদ্ধর জগন্নাথ পতিতং ভবসাগরে।
গৃহাণার্ঘ্য ময়া দত্তং পদ্মনাভ নমোহস্তু তে।।”

 জয়া মহাদ্বাদশী ব্রহ্মপুরাণে শ্রীবশিষ্ঠ-মান্ধাতা সংবাদে এই মহাদ্বাদশীর কথা বলা হয়েছে। শুক্লপক্ষের দ্বাদশীতে ‘পুনর্বসু’ নক্ষত্র যুক্ত হলে তাকে সর্বোত্তমা ‘জয়া’ মহাদ্বাদশী বলা হয়। এই ব্রত উপবাসে ভয়ঙ্কর নরকযন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ লাভ হয় এবং অগ্নিষ্টোমাদি যজ্ঞের ফল পাওয়া যায়।

 বিজয়া মহাদ্বাদশী শুক্লপক্ষের দ্বাদশী তিথিতে শ্রবণা নক্ষত্রের যোগ হলে সেই মহা পবিত্র দ্বাদশীকে ‘বিজয়া’ বলা হয়। ভাদ্র মাসের বুধবারে বিজয়া ব্রত হলে সমস্ত ব্রত থেকে এই ব্রতের মাহাত্ম্য অধিক হয়। এই তিথি আবার শ্রবণ-মহাদ্বাদশী নামেও পরিচিত হয়। বিষ্ণুধর্মোত্তরে এই ব্রতের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, এই তিথিতে পবিত্র তীর্থ স্নানে সমস্ত তীর্থ-স্নানের ফল পাওয়া যায়। সারা বৎসরের পূজার ফল কেবল এই ব্রত পালনেই লাভ হয়। এই দিনে একবার মাত্র ভগবানের নাম জপে এক হাজার বার জপের ফল অর্জিত হয়। এই তিথিতে দান, বৈষ্ণবভোজন,  হোম, উপবাসে হাজার গুণ বেশি ফল লাভ হয়ে থাকে।

 জয়ন্তী মহাদ্বাদশী শুক্লপক্ষের দ্বাদশী তিথিতে রোহিণী নক্ষত্র যুক্ত হলে সেই পবিত্র দ্বাদশীকে ‘জয়ন্তী’ বলা হয়। এই প্রসঙ্গে শ্রীব্রহ্মপুরাণে বর্ণিত হয়েছে যে, সমস্ত পাপহরণকারী এই তিথিতে শ্রীহরির পূজাসহকারে ব্রত- উপবাসে সাত জন্মের পাপ দুর হয়ে যায়। যে মানুষ বেঁচে থাকতেও এই ব্রত পালন করে না, তার জীবন বৃথা। এই তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের পূজা বিশেষভাবে করতে হয়।

 ‘হে মধুসূদন! আপনি অসংখ অবতার গ্রহণ করেন। জগতে এমন কেই নেই যে আপনার সেসকল অবতারের গণনা করতে সমর্থ হয়। ব্রহ্মাদি দেবতাদের কাছেও আপনার স্বরূপ অজ্ঞাত। জননীর কোলে অবস্থানরত আপনাকে আমি পূজা করি। হে দেব! হে ভবভয় মোচনকারী, আমার দুস্কৃতি নাশ  অভীষ্ট প্রদান করে আমাকে কৃপা করুন। এইভাবে ভক্তিসহকারে জয়ন্তী মহাদ্বাদশী পালন করলে একুশ পুরুষ পর্যন্ত উদ্ধার প্রাপ্ত হয়। শ্রীহরির অত্যন্ত প্রীতিকর এই ব্রতের অনুষ্ঠানে সকল মনোবাসনা পূর্ণ ও বিষ্ণুলোকে গতি হয়। 

অবতারসহস্রাণি করোষি মধুসূদন।
ন তে সংখ্যাবতারাণাং কশ্চিজ্জানাতি বৈ ভুবি।।
দেবা ব্রহ্মাদয়ো বাপি স্বরূপং ন বিদুস্তব।
অতস্ত্বাং পূজয়িষ্যামি মাতৃরুৎসঙ্গসংস্থিতম্।।
বাঞ্চিতং কুরু মে দেব দুস্কৃতং চৈব নাশয়।
কুরুষ্ব মে দয়াং দেব সংসারর্তি-ভয়পহ।।

 পাপনাশিনী মহাদ্বাদশী শুক্লপক্ষের দ্বাদশী তিথিতে পুষা-নক্ষত্রের যোগ হলে সেই দ্বাদশীকে ‘পাপনাশিনী’ বলা হয়। ব্রহ্মপুরাণে বলা হয়েছে যে, মহাপুণ্য স্বরূপিণী এই তিথিতে মহারাজ সগর, ককুৎস্থ, ধন্ধুমার ও গাধি শ্রীহরির উপাসনা করে সসাগরা পৃথিবীর রাজা হয়েছিলেন। এই ব্রত উপবাসে কায়িক, বাচিক, মানসিক, সমস্ত পাপ থেকে মুক্তি লাভ হয়। পুষা-নক্ষত্রযুক্তা এই দ্বাতশীর উপবাসে এক হাজার একাদশীর ফল লাভ হয়ে থাকে। এই তিথিতে স্নান, দান, জপ, হোম, বেদধ্যয়ন আদি অনন্তগুণ ফল প্রদান করে।