রসুন | জেনে নিন রসুনের উপকারিতা
স্বাস্থ্যরক্ষায় রসুন খাওয়ার চল বহু দিনের। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ শতকে চিন ও ভারতে রক্ত পাতলা রাখার জন্য এর প্রচলন ছিল। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটিসও একে ব্যবহার করেছিলেন সারভাইকাল ক্যানসারের চিকিৎসায়। লুই পাস্তুর এর অ্যান্টিফাঙ্গাল ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণের খবর জানান। সময়ের সঙ্গে আরও উপকারের কথা জানা গিয়েছে।
আধুনিক বিজ্ঞানীরা জানালেন হৃদরোগ প্রতিরোধে এর ভূমিকার কথা। ইউনিভার্সিটি অফ কানেটিকাটের স্কুল অফ মেডিসিন–এর কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ টিমের বিজ্ঞানীদের দাবি, কাঁচা রসুন খেলে হার্ট অনেক বেশি সুস্থ থাকে। রক্তচাপ বশে রাখতেও তার ভূমিকা আছে। কোভিডের জটিলতা বাড়াতে হৃদরোগ ও হাই প্রেশারের কোনও জুড়ি নেই। কাজেই নিয়মিত রসুন খেলে যদি হার্ট ও রক্তচাপ ঠিক থাকে, কম থাকবে কোভিডের জটিলতাও। এর আরও নানা উপকার আছে।
যেমন–
• নিয়মিত রসুন খেলে মোট কোলেস্টেরল ও খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএলের প্রায় ১০–১৫ শতাংশ কমে যায়। তবে উপকারি কোলেস্টেরল বা এইচডিএল বাড়াতে ও ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে এর কোনও ভূমিকা নেই।
• বিপাকীয় ক্রিয়া ও পরিবেশ দূষণের ফলে শরীরে যে ফ্রি র্যাডিক্যালস তৈরি হয় তা হার্ট তথা সমস্ত শরীরের জন্য ক্ষতিকর। রসুনের অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট সেই ক্ষতি খুব ভাল ভাবে ঠেকাতে পারে। কোভিডেও উপকার হয় তাতে।
• হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যে সমস্ত হৃদরোগী নিয়মিত রসুন খান, তাঁরা অনেক বেশি সক্রিয় থাকেন। তবে এ বিষয়ে অনেক গবেষণার প্রয়োজন।
• আয়ুর্বেদ বলছে, সবচেয়ে ভাল ফল পেতে গেলে সাপ্লিমেন্ট না খেয়ে খেতে হবে কাঁচা রসুন।
কাঁচা রসুনই কেন
জার্নাল অফ এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ফুড কেমিস্ট্রিতে প্রকাশিত প্রবন্ধে কাঁচা ও শুকনো রসুনের প্রভাব বিচার করেছেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণাগারে বড় হওয়া দু–দল ইঁদুরের মধ্যে এক দলকে বেশ কিছু দিন ধরে খাওয়ানো হয় টাটকা কাঁচা রসুন, আরেক দলকে শুকনো রসুন। এরপর তাদের মধ্যে হালকা হার্ট অ্যাটাক সৃষ্টি করিয়ে তাঁরা দেখেন কোন গ্রুপের ইঁদুর কীভাবে সামলাচ্ছে এর ধাক্কা।
হার্ট অ্যাটাকের ফলে অক্সিজেনের অভাবে হার্টের পেশির যে ক্ষতি হয়েছে, দু–দল ইঁদুরই তা সামলেছে প্রায় একই রকম দক্ষতায়। তবে যাঁরা কাঁচা রসুন খেয়েছিল, এই বিপর্যয়ের পরও তাদের হার্টের মূল ধমনি দিয়ে রক্ত সঞ্চালন বেশি ভালোভাবে হয়েছে ও হার্টের মধ্যে এমন কিছু পরিবর্তন হয়েছে যাতে চট করে রোগের ধকল সামলে উঠেছে তারা।
এ ব্যাপারে হিউম্যান ট্রায়াল না হলেও মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়, কাঁচা রসুনের যত উপকার, রান্না করার পর আর তত থাকে না।
পুষ্টিবিদ প্রিয়াঙ্কা মিশ্র জানিয়েছেন, কাঁচা রসুন কাটলে বা বাটলে যে ঝাঁঝালো গন্ধ বেরোয় তার মূলে আছে অ্যালিসিন। মাপমতো খেলে যা ওষুধের মতো কাজ করে। রসুন কাটা বা বাটার পর সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে না নিলে সে আস্তে আস্তে উবে যায়। সে জন্যই রসুন শুকিয়ে বা রান্নায় দিয়ে খেলে উপকার কমে যায়। প্যাকেটের রসুন বাটা বা সাপ্লিমেন্টেও এই উপকার থাকে না। তাছাড়া, অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টের মাত্রাও বেশি থাকে কাঁচা রসুনে। পূর্ণবয়স্কদের ক্ষেত্রে ২-৩টি রসুনের কোয়া খেতে বলছেন পুষ্টিবিদরা। রোজ সকালে এক কোয়া রসুন কাঁচা চিবিয়ে খেলে তা সবচেয়ে বেশি উপকারে আসে।
কখন, কীভাবে
আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেবাশিস ঘোষ বলেন, ‘‘সকালে খালি পেটে খেতে হবে এমন নয়। বিকেল-দুপুর বা রাতে খেতে পারেন। পুরো উপকার পেতে গেলে খেতে হবে কাঁচা, আগেই বলা হয়েছে। এমনি খেতে অসুবিধা হলে ধনেপাতার সঙ্গে বেটে নিন। নারকেল বা কচু বাটায় মেশান। স্যালাডে বা দইয়ে মিশিয়ে খান। কারও ভয় একটাই, শ্বাসে কটূ গন্ধ হবে কি না। সে উপায়ও আছে। একটু পার্সলে পাতা চিবিয়ে নিন, দাঁত মাজুন বা ব্যবহার করুন মাউথ-ওয়াশ, গন্ধ চলে যাবে।’’
দেখে নিন রসুন দুধ পান করার উপকারিতা
১. রসুনের দুধ যা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি যৌগগুলিতে সমৃদ্ধ। রসুনের দুধ ভাইরাসজনিত রোগ থেকে রক্ষা করতে খুব উপকারী এবং এটি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও সুস্থ রাখে। রাতে ঘুমানোর আগে রসুনের দুধ পান করে কোলেস্টেরল হ্রাস পায়। এমনকি স্তন্যদানকারী মহিলাদের জন্য উপকারী।
২. অ্যাজমা, কফ, নিউমোনিয়া সমস্যা-যাদের অ্যাজমা, কফ, নিউমোনিয়ার সমস্যা রয়েছে প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে দুধে রসুন মিশিয়ে খেলে সমস্যা দুর হয়।
৩. কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে- দুধের সঙ্গে রসুন মিশিয়ে খেলে খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। ভালো কোলেস্টেরল বাড়াতেও সাহায্য করে।
৪. জন্ডিসের প্রতিকার-রসুন-দুধ জন্ডিসের ক্ষেত্রে ভালো কাজ করে।
৫. বাতের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে-গাঁটে গাঁটে ব্যথা অনেক কমিয়ে দেয় এই রসুন দুধ। এমনিতেই গরম দুধ ব্যথা কমায়, সেই সঙ্গে রসুন প্রদাহ থেকে রক্ষা করে। সব মিলিয়ে খুব ভালো উপকার পাওয়া যায়।
৬. অনিদ্রার সমস্যা-হাজার চেষ্টা করলেও রাতে ঠিক করে ঘুম হয় না। এক গ্লাস রসুন-দুধ খেয়ে নিন। সমস্যা দুর হয়ে যাবে।
ত্বকের লালচে ভাব দূর করে
রসুনে থাকা অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান ব্রণের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াকে দূর করে। আপনি যদি এ থেকে মুক্তি পেতে চান, তবে দুই কোয়া রসুন পিষে নিন এবং তাতে এক টেবিল চামচ মধু ও তিন টেবিল চামচ দই মেশান। এবার মিশ্রণটি ব্রণ বা ক্ষতস্থানে লাগান। এভাবে ১০ মিনিট রেখে দিন। দেখবেন, এতে ব্রণের আকার কমবে এবং লালচে ভাব দূর হবে।
নখের হলদে ভাব দূরীকরণে
অতিরিক্ত নেইলপালিশ ব্যবহার নখের স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। ফলে নখ হলুদ হয়ে যায়। এর প্রতিকারে কয়েকটি রসুনের কোয়া পিষে নিন এবং নখের ওপর ঘষুন। দুই মিনিট রেখে টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলুন। সপ্তাহে এমনটা দুবার করলে ভালো ফল মিলবে।
মাতৃত্বজনিত দাগ দূরীকরণে
আপনি যদি মাতৃত্বজনিত দাগ দূর করতে চান, তবে কয়েক কোয়া রসুন পিষে তা ওই দাগের স্থানে ঘষুন। পেষা রসুনে এক টেবিল চামচ আমন্ড অয়েল মেশান এবং মিশ্রণটি গরম করুন। তবে সেদ্ধ করবেন না। মিশ্রণটির তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এলে ওই দাগের ওপর লাগান।
খুশকি দূরীকরণে
শীতে বেশি খুশকি হয়। আর এ থেকে মুক্তি পেতে আপনি রসুনের সাহায্য নিতে পারেন। এক কোয়া রসুন পিষে নিন এবং এতে এক কাপের চার ভাগের এক ভাগ অলিভ অয়েল মেশান। হালকা তাপে গরম করুন। মিশ্রণটি ঠাণ্ডা হতে দিন। এবার ওই মিশ্রণ আপনার মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করুন। এতে খুশকি কমবে এবং চুলের বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।