অশোক ষষ্ঠীর ব্রত | Ashok Sasthi Brata

অশোক ষষ্ঠীর ব্রত | Ashok Sasthi Brata

চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতিথিতে অশোকষষ্ঠী ব্রত Ashok Sasthi Brata পালন করতে হয়। স্ত্রীলোকেরাই এই ব্রত পালন করে থাকে। অশোক ফুল, মুগকড়াই, দই। চৈত্র মাসে শুক্লপক্ষে ষষ্ঠী তিথিতে স্ত্রীলোকেরা অশোকষষ্ঠী ব্রত পুজো করবে। তারপর প্রত্যেকে ছ’টি মুগ কড়াই ও ছটি অশোক ফুলের কুঁড়ি দই মাখিয়ে খাবে। ঐদিন ভাত খাওয়া নিষেধ। লুচি পরটা ইত্যাদি খাওয়ার কোনো বাধা নেই। ফল-মূল ও খাওয়া যেতে পারে। 

রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত আকাশে। শুধু কবির ভাবনাতেই নয় বাস্তবেও যে গাছ দুঃখহারী সে হল অশোক গাছ। অশোক, অপশোক, অঞ্জনপ্রিয়া, কঙ্গেলি, কর্ণপূরক, কেলিক, চিত্র, দোষহারী, নট, পল্লবদ্রুপ, পিণ্ডিপুষ্প, প্রপল্লব, বঞ্জুলদ্রুম, বিচিত্র, বিশোক, মধুপষ্প, রক্তপল্লবক, রাগীতরু, রামাবামাঙ্ঘিধাতক, শোকনাশ, সুভগ, স্মরাধিবাস, হেমপুষ্প নানান নামে পরিচিত অশোক চীন, ভারতবর্ষ, শ্রীলঙ্কা অঞ্চলের স্থানীয় বৃক্ষ বিশেষ। আমাদের এই দেশী বৃক্ষটির খ্যাতি সুপ্রাচীন। কাব্যে বহুল ব্যবহার ছাড়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে অশোক যুক্ত।

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে – গৌরী দেবী এই বৃক্ষের নিচে তপস্যা করে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন এবং শোক থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। সেই কারণে এই বৃক্ষের নাম অশোক হয়েছে। এই গাছ ভারতবর্ষ ও শ্রীলঙ্কাতে প্রচুর পাওয়া যায়। কথিত আছে গৌতম বুদ্ধ লুম্বিনি-তে এই গাছের নিচে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এবং মহাবীর এই গাছের নিচে ধ্যান করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। রামায়ণে উল্লেখ আছে– রাম সীতাকে অপহরণ করে অশোকবনে রেখেছিলেন। হিন্দু ও বৌদ্ধদের কাছে এ ফুল অত্যন্ত পবিত্র। শোক নাশ করে বলেই এর নাম অশোক।

 

অশোক ষষ্ঠীর ব্রতকথা— সে যুগে তপোবনে এক মুনি থাকতেন। বনটির চারিদিকে অনেক অশোক গাছ জন্মেছিল। মুনি একদিন সকালে পুজোর ফুল তুলতে তুলতে দেখলেন, একটা অশোক গাছের গোড়ায় খুব সুন্দর একটি সদ্যোজাত মেয়ে কাঁদছে। মুনি তখনই মেয়েটিকে তুলে নিয়ে তাঁর আশ্রমে ফিরে গেলেন। পরে ধ্যান করে তিনি জানতে পারলেন যে, শাপের ফলে হরিণরূপিণী এক স্ত্রীলোক এই মেয়েটিকে প্রসব করেছে।

মুনি মেয়েটিকে খুব যত্নে লালন-পালন করতে লাগলেন। হরিণীও রোজ একবার করে এসে মেয়েটিকে দুধ খাইয়ে যেতে লাগল। অশোক গাছের গোড়ায় তাকে পাওয়া গিয়েছিলো বলে মুনি মেয়েটির নাম রাখলেন অশোকা। এই ভাবে মেয়েটি ক্রমে বেশ বড় হয়ে উঠল। এখন তার বিয়ে দেওয়া দরকার। মুনি তখন মনে মনে স্থির করলেন যে, পরের দিন সকালে প্রথমে তিনি যার মুখ দেখবেন, তারই সঙ্গে অশোকার বিয়ে দেবেন।

দৈবের লীলা কে বুঝবে? পরের দিন সকালে উঠে মুনি দেখতে পেলেন যে, এক রাজপুত্র তার অনেক লোকজন নিয়ে আশ্রমের দরজায় অপেক্ষা করছে। মুনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি এখানে এসেছো কেন?” রাজপুত্র বলল, “আমি মৃগয়া করতে বেরিয়েছিলাম কাল রাত্তিরে খুব ঝড় জল হওয়ায় আর ফিরতে পারিনি, আপনার কুটীরে আশ্রয় নিয়েছিলাম।”

মুনি দেখলেন ভাল সুযোগ, তখন তিনি রাজপুত্রকে নিজের ইচ্ছার কথা জানালেন। মুনির কথা শুনে রাজপুত্র মেয়েটিকে বিয়ে করতে রাজী হল আর মুনি রাজপুত্রের হাত ধরে অশোকাকে তার হাতে সঁপে দিলেন। মুনি পরে বললেন, “কুমার! আমি তোমার পরিচয় জানি না আর তুমিও এর পরিচয় জানো না, তবুও আমার কথায় তুমি একে বিয়ে করলে—তুমি আর তোমার বাবা, এ বিয়েতে খুশীই হবেন।

অশোকা খুবই গুণের মেয়ে।” তারপর মুনি আবার অশোকাকে বললেন, “মা অশোকা, এই অশোক ফুলের বীচিগুলো দিচ্ছি নিয়ে যা আর এখান থেকে যাবার পথে বীচিগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে দিস, তাহলে রাজবাড়ি পর্যন্ত অশোকগাছের সারি হয়ে যাবে আর দরকার হলে তুই একলাই এই অশোকগাছের সারি ধরে আমার কাছে পথ চিনে আসতে পারবি। আর অশোক ফুলগুলো শুকিয়ে রেখে দিস, চৈত্র মাসে অশোক ষষ্ঠীর দিনে ওগুলো খাস, তাহলে জীবনে কখনো শোক তাপ পাবি না।”

মুনিকে প্রণাম করে রাজপুত্র অশোকাকে সঙ্গে নিয়ে রাজবাড়িতে ফিরে গেল। রাজা-রাণী সব শুনে খুশী মনেই ছেলে-বৌকে বরণ করে ঘরে তুললেন। এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। অশোকার সাত ছেলে ও এক মেয়ে হয়েছে, রাজা-রাণী সময়মতো সকলেরই বিয়ে দিয়ে স্বর্গে গেছেন। একবার চৈত্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে রাজার বাৎসরিক শ্রাদ্ধের তিথি পড়ল।

অশোকা বৌয়েদের ডেকে বলল, “আজ অশোক ষষ্ঠী, আমি আজ ভাত খাবো না।” বৌয়েরা তখন মুগকড়াই সেদ্ধ করে দিল। সারা দিন কাজকর্ম করার পর ক্লান্ত হয়ে রাত্তিরে সকলেই ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন অশোকা দেখল যে, ছেলের বৌয়েরা কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। শেষে ঘরের দরজা ভেঙ্গে ফেলে অশোকা দেখলে যে, সকলেই বিছানায় মরে পড়ে আছে।

এই অবস্থায় পড়ে অশোকার হঠাৎ মুনির কথা মনে পড়ে গেল। অমনি সে অশোক গাছের সারি ধরে মুনির কাছে গিয়ে হাজির হল। মুনি অশোকার সব কথা শুনে ধ্যান করে সব কথা জানতে পারলেন আর অশোকাকে বললেন যখন সেদ্ধ করছিল তখব অসাবধানে একটা ধান তার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল, আর তাই খাওয়ার জন্যে সেই পাপে ওই দুর্দশা হয়েছে তাদের।

যাক তুই এই কমণ্ডলুর জল নিয়ে গিয়ে তাদের গায়ে ছিটিয়ে দে, তাহলেই সকলে বেঁচে উঠবে। অশোক ষষ্ঠীর দিন খুব সাবধানে ছ’টি অশোক কুঁড়ি, ছ’টি মুগ কড়াই, দই দিয়ে খেয়ে তবে অন্য জিনিস খাস্।” মুনির কাছ থেকে কমণ্ডলুর জল নিয়ে এসে, অশোকা সবার গায়ে ছিটিয়ে দিতে তারা সকলেই বেঁচে উঠলো। তার পর মায়ের মাহাত্ম্য ক্রমে ক্রমে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।