দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা

পশ্চিমবঙ্গের প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্যতম একটি প্রশাসনিক জেলা হল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা South 24 Parganas district ।আয়তনের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম ও জনসংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা হল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। জনসংখ্যার নিরিখে ভারতের ৭৩৯টি জেলার মধ্যে এই জেলার স্থান ষষ্ঠ। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মোট জনসংখ্যা ৮,১৬১,৯৬১,জেলার জনঘনত্ব ৮১৯ জন প্রতি বর্গকিলোমিটার ।২০০১-২০১১ দশকে এই জেলার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৮.০৫ শতাংশ।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার লিঙ্গানুপাতের হার হল প্রতি ১০০০ পুরুষে ৯৪৯ জন মহিলা এবং সাক্ষরতার হার ৭৮.৫৭ শতাংশ। এই জেলার সদর আলিপুরে অবস্থিত।  এই জেলার উত্তর দিকে কলকাতা ও উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা, পূর্ব দিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র, পশ্চিম দিকে হুগলি নদী ও দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলিকাতা জমিদারির অন্তর্গত চব্বিশটি "পরগনা" নিয়ে অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা জেলা গঠিত হয়েছিল। এই চব্বিশটি পরগনা   মনপুর, মৈদা,  মুড়াগাছা, আকবরপুর, খারিজুড়ি,  খাসপুর,  মৈদানমল বা মেদনিমল,  মগুরা, আজিমাবাদ, বলিয়া,  পাইকান, বরিধারি,  বাসনন্ধরি,  কলিকাতা,  আমিরপুর, দখিন সাগর,  গড়,  হাতিগড়, ইখতিয়ারপুর,  পিছাকুলি,  সতল,  শাহনগর,  শাহপুর ও  উত্তর পরগনা। ১৯৮৬ সালের ১ মার্চ চব্বিশ পরগনা জেলার দক্ষিণাংশ নিয়ে গঠিত হয় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলাটি।

এই অঞ্চলের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১ম খ্রিস্টপূর্বের দিওদোরাস সিকুলাসের লেখা বিব্লিওথেকে ইস্তোরিকে গ্রন্থে। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে গ্রিক ভুগোলবিদ টলেমির তার গেওগ্রাফিকে উ্যফেগেসিস গ্রন্থে গঙ্গারিডি বা গঙ্গারিদাই নামক একটি অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে, যার বিস্তার গঙ্গার নদীমুখের সমগ্র অঞ্চলজুড়ে ছিল।বিদ্যাধরী নদী সংলগ্ন এই প্রত্নস্থলটির সঙ্গে জলপথে প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল বিশেষত রোমের বাণিজ্যিক যোগসূত্রের সুনিশ্চিত প্রমাণ মিলেছে।

প্রাচীনকাল থেকে ষোড়শ শতক অবধি আদি ভাগিরথীর পারে কালিঘাট, বোড়াল, রাজপুর, মহিনগর, বারুইপুর, জয়নগর, মজিলপুর, ছত্রভোগের মত জনপদ গড়ে উঠেছিল। বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসাবিজয় থেকে এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম এবং নগরের তালিকা পাওয়া যায়। শ্রী চৈতন্যদেব ভাগিরথীর পার ধরে পুরি যাওয়ার পথে বারুইপুরের কাছে আটসিরাতে এবং সর্বশেষ মথুরাপুরের ছত্রভোগে থেমেছিলেন।দক্ষিণ ২৪ পরগনায় গড়িয়ায় পূর্বে বিদ্যাধরী নদীর তীরে তার্দা বন্দরে ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজরা প্রথম ঘাঁটি গাড়ে।

এরপর এই সময়ে বাংলায় মুঘলদের বিরুদ্ধে বারো ভুইয়াঁদের মিত্রশক্তি হয়ে ওঠে পর্তুগীজরা এবং নদী তিরবর্তী অঞ্চলে তাদের জলদস্যুতা বজায় রাখতে থাকে। পরবর্তি ১০০ বছর তাদের আধিপত্য বজায় ছিল উত্তর ২৪ পরগনা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন অঞ্চলে। এর ফলে এই অঞ্চলে অনেক সমৃদ্ধশালী জনপদ জনশূন্য হয়ে যায়। ১৬১০ সালে সলকা ও মগরাহাটের যুদ্ধে মুঘল সেনাপতি মান সিংহের হাতে প্রতাপাদিত্য পরাজিত হন।

মান সিংহ ছিলেন কামদেব ব্রহ্মচারীর শিষ্য। কামদেবের বংশধর হালিশহরের জায়গিরদার লক্ষীকান্ত মজুমদারকে ১৬১০ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর মাগুরা, পাইকান, আনোয়ারপুর, কলকাতা ইত্যাদি একুশটি অঞ্চলের জমিদারি স্বত্ত্ব দেন। প্রতাপাদিত্য যখন রাজা বসন্ত রায়কে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন তখন থেকে প্রতাপাদিত্যের সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন লক্ষ্মীকান্ত। লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারের নাতি কেশবচন্দ্র মজুমদার মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে বর্তমানের দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও খুলনা অঞ্চলের জমিদার নিযুক্ত হন।

১৭২২ সালে মুর্শিদকুলি খাঁর সময়ে মোগল আমলের শেষ জরিপে ওই পরগনাগুলিকে হুগলি চাকলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পলাশীর যুদ্ধের ছয় মাস পরে ১৭৫৭ সালে ২০শে ডিসেম্বর মীরজাফর ইংরেজদের কলকাতা সহ দক্ষিণে কুলপী পর্যন্ত ২৪টি পরগনাকে কলকাতার জমিদারি বা ২৪ পরগনার জমিদারির নামে ৮৮২ বর্গমাইল এলাকা দান করেছিলেন।১৮৭১ সালে কলকাতা ২৪ পরগনা জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতের রাজধানীতে পরিণত হয়। ১৯৮৩ সালে ডঃ অশোক মিত্রের প্রসাসনিক সংস্কার কমিটি এই জেলাকে বিভাজনের সুপারিশ করে। ১৯৮৬ সালে ১লা মার্চ জেলাটিকে উত্তর ২৪ পরগণা জেলা ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা নামে দুটি জেলায় ভাগ করা হয়। দুটি জেলাই প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত।

 দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা মহকুমার 

বর্তমানে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা পাঁচটি মহকুমায় বিভক্ত আলিপুর সদর, বারুইপুর, ডায়মন্ড হারবার, ক্যানিং ও কাকদ্বীপ।এই জেলায় মোট ৩৩টি থানা, ২৯টি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, ৭টি পুরসভা ও ৩১২টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাDakshin 24 Pargana Zela অন্তর্গত সুন্দরবন অঞ্চল বারোটি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক জুড়ে অবস্থিত: সাগর, নামখানা, কাকদ্বীপ, পাথরপ্রতিমা, কুলতলি, মথুরাপুর ১, মথুরাপুর ২, জয়নগর ২, ক্যানিং, ক্যানিং ২, বাসন্তী ও গোসাবা। জেলায় মোট ৩৭টি দ্বীপ আছে। পুরসভা এলাকাগুলি ছাড়া দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার প্রত্যেকটি মহকুমার অন্তর্গত সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকগুলি আবার গ্রামীণ অঞ্চল ও জনগণনা নগরে বিভক্ত। জেলায় মোট ১১৮টি নগরাঞ্চল রয়েছে সাতটি পুরসভা ও ১১১টি জনগণনা নগর।

আলিপুর সদর মহকুমার অন্তর্গত এলাকাগুলি হল কলকাতা পৌরসংস্থার অন্তর্গত  অঞ্চলসমূহ: ঢাকুরিয়া, গড়িয়াহাট, চারু মার্কেট, টালিগঞ্জ, চেতলা, নাকতলা, যোধপুর পার্ক, গলফগ্রিন, রিজেন্ট পার্ক, যাদবপুর, গড়ফা, কালিকাপুর, হালতু, নন্দীবাগান, বালিগঞ্জ, আলিপুর, ভবানীপুর, কালীঘাট, অজয়নগর, সন্তোষপুর, বাঘাযতীন, চক গড়িয়া,কামালগাজি, নরেন্দ্রপুর, রানিকুঠি, বাঁশদ্রোণী, কুঁদঘাট,  নিউ গড়িয়া, নেতাজিনগর, পাঁচপোতা, টেকনো সিটি, তেঁতুলবেড়িয়া, বৈষ্ণবঘাটা পাটুলি, গড়িয়া, ঢালাই ব্রিজ, মডেল টাউন, একবালপুর, হরিদেবপুর, হেস্টিংস, রাজাবাগান, ওয়াটগঞ্জ, গার্ডেনরিচ, খিদিরপুর, মেটিয়াবুরুজ, তারাতলা, বড়তলা, বিএনআর কলোনি, বেহালা, সরসুনা, জোকা, বড়িশা, পর্ণশ্রী পল্লি ও ঠাকুরপুকুর।

তিনটি পুরসভা হল মহেশতলা, বজবজ ও পূজালি। বিষ্ণুপুর ১ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা এগারোটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও চারটি জনগণনা নগর নিয়ে গঠিত। বিষ্ণুপুর ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা এগারোটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও এগারোটি জনগণনা নগর  নিয়ে গঠিত। বজবজ ১ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা ছয়টি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং সাতটি জনগণনা নগর  নিয়ে গঠিত।বজবজ ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা এগারোটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও পাঁচটি জনগণনা  নিয়ে গঠিত।ঠাকুরপুকুর মহেশতলা সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা ছয়টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও নয়টি জনগণনা নগর নিয়ে গঠিত।

ডায়মন্ড হারবার মহকুমা  ডায়মন্ড হারবার ১ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা আটটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও চারটি জনগণনা নগর নিয়ে গঠিত। ডায়মন্ড হারবার ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা আটটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও পটদহ জনগণনা নগর নিয়ে গঠিত।ফলতা সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা তেরোটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও চারটি জনগণনা নগর নিয়ে গঠিত।  কুলপি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা চোদ্দোটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও দু’টি জনগনা নগর নিয়ে গঠিত।

মগরাহাট ১ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা এগারোটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও নয়টি জনগণনা নগর নিয়ে গঠিত। মগরহাট ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা চোদ্দোটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও আটটি জনগণনা নগর  নিয়ে গঠিত।মন্দিরবাজার সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা দশটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও তিনটি জনগণনা নগর নিয়ে গঠিত। মথুরাপির ১ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা দশটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও চারটি জনগণনা নগর নিয়ে গঠিত। মথুরাপুর ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা শুধুমাত্র এগারোটি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত।

কাকদ্বীপ মহকুমা কাকদ্বীপ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা শুধুমাত্র এগারোটি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত। নামখানা সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা শুধুমাত্র সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত। পাথরপ্রতিমা সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা শুধুমাত্র পনেরোটি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত।সাগর সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা শুধুমাত্র নয়টি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত।

ক্যানিং মহকুমা  বাসন্তী সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা তেরোটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও বাসন্তী জনগণনা নগর নিয়ে গঠিত। ক্যানিং ১ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা দশটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও আটটি জনগণনা নগর  নিয়ে গঠিত।ক্যানিং ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা নয়টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও মাখালতলা জনগণনা নগর নিয়ে গঠিত। গোসাবা সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা শুধুমাত্র চোদ্দোটি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত।

বারুইপুর মহকুমা  তিনটি পুরসভা: রাজপুর সোনারপুর, বারুইপুর ও জয়নগর মজিলপুর। বারুইপুর সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা উনিশটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও বারোটি জনগণনা নগর নিয়ে গঠিত। ভাঙড় ১ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা নয়টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও তিনটি জনগণনা নগর নিয়ে গঠিত।

ভাঙড় ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা শুধুমাত্র দশটি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত।জয়নগর ১ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা বারোটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও ছয়টি জনগণনা নগর নিয়ে গঠিত।জয়নগর ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা দশটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও দু’টি জনগণনা নগর  নিয়ে গঠিত।কুলতলি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, শুধুমাত্র নয়টি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত।সোনারপুর সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, যা এগারোটি গ্রাম পঞ্চায়েত ও সাতটি জনগণনা নগর  নিয়ে গঠিত।

 

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বিধানসভা কেন্দ্র

১২৭ গোসাবা ১২৮ বাসন্তী ১২৯ কুলতলি ১৩১ কাকদ্বীপ ১৩২ সাগর ১৩৩ কুলপি ১৩৪ রায়দিঘি ১৩৫ মন্দিরবাজার ১৩৬ জয়নগর ১৩৭ বারুইপুর পূর্ব ১৩৮ ক্যানিং পশ্চিম ১৩৯ ক্যানিং পূর্ব ১৪০ বারুইপুর পশ্চিম ১৪১ মগরাহাট পূর্ব ১৪২ মগরাহাট পশ্চিম ১৪৩ ডায়মন্ড হারবার ১৪৪ ফলতা ১৪৫ সাতগাছিয়া ১৪৬ বিষ্ণুপুর ১৪৭ সোনারপুর দক্ষিণ ১৪৮ ভাঙড় ১৪৯ কসবা ১৫০ যাদবপুর ১৫১ সোনারপুর ১৫২ টালিগঞ্জ ১৫৩ বেহালা পূর্ব ১৫৪ বেহালা পশ্চিম ১৫৫ মহেশতলা ১৫৬ বজবজ ১৫৭ মেটিয়াবুরুজ

 

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মোট জনসংখ্যার

জেলার মোট জনসংখ্যার ৩৪.১১ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে, যা রাজ্য ও জাতীয় দারিদ্র্য অনুপাতের অনেক উপরে। সুন্দরবনের জনবসতি এলাকায় অবস্থিত তেরোটি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের নথিবদ্ধ  দারিদ্র্য অনুপাত নিম্ন দারিদ্র্যসীমায় অবস্থানকারী জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের উপরে এবং আটটি ব্লকের ক্ষেত্রে এই হার ৪০ শতাংশের উপরে।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা অনুন্নত অঞ্চলের তালিকাভুক্ত। এই জেলাটি অনুন্নত অঞ্চল অনুদান তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্য লাভ করে। মৎস্যচাষ সমগ্র দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জীবিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ২০০১ সালের হিসাব অনুযায়ী, সাড়ে চার লক্ষেরও বেশি লোক এই জেলায় মৎস্যচাষের সঙ্গে যুক্ত।

এদের মধ্যে ২.৫৭ লক্ষ মানুষের বাস সুন্দরবন বসতি অঞ্চলের তেরোটি ব্লকে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী  দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় সাক্ষরতার হার ৭৭.৫১ শতাংশ। আলিপুর সদর মহকুমায় সাক্ষরতার হার ৮১.১৪ শতাংশ, বারুইপুর মহকুমায় ৭৭.৪৫ শতাংশ, ক্যানিং মহকুমায় ৭০.৯৮ শতাংশ, ডায়মন্ড হারবার মহকুমায় ৭৬.২৬ শতাংশ এবং কাকদ্বীপ মহকুমায় সাক্ষরতার হার ৮২.০৪ শতাংশ।

কলকাতা পৌরসংস্থার অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অংশগুলি বাদে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বাকি  অংশে   প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩,৭৫৬ টি, মধ্য বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৬৪ , উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৭৫ টি, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০১ টি , সাধারণ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ২৭ টি, প্রযুক্তি / পেশাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান আছে ২০ টি।

এই জেলার বিভিন্ন প্রত্নস্থল থেকে প্রস্তর যুগের প্রত্ন নিদর্শন পাওয়া যায়। এগুলি হলো  ডায়মন্ড হারবার অঞ্চলের দেউলপোতা, কুলপি অঞ্চলের হরিনারায়ণপুর, সাগরদ্বীপ, সোনারপুর অঞ্চলের বোড়াল এবং দক্ষিণ গোবিন্দপুর, বারুইপুর অঞ্চলের মল্লিকপুর-হরিহরপুর এবং আটঘরা এবং পাথরপ্রতিমা অঞ্চলের গোবর্ধনপুর। এই অঞ্চলে প্রথম বসতির প্রমাণ হিসাবে প্রস্তরযুগের মানুষের ব্যবহৃত নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে ডায়মন্ড মহকুমার দেউলপোতা ও হরিনারায়ণপুরে।

বারুইপুরের পাঁচমাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে কুলদিয়া গ্রামে বেশ সুন্দর একটি সূর্যমূর্তি এবং সঙ্গে বেলেপাথরের নৃসিংহের একটি প্লাক পাওয়া গিয়েছে।গোবিন্দপুরের মাইলখানেক দক্ষিণে বেড়াল-বৈকুণ্ঠপুরে প্রাচীন একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় এবং আরও দক্ষিণে কল্যাণপুর গ্রামে প্রাচীন একটি জীর্ণ মন্দিরে একটি শিবলিঙ্গ আছে যাঁকে 'রায়মঙ্গল' কাব্যের 'কল্যাণ-মাধব' বলে চিহ্নিত করা হয়।

১৯২৩ সালে বারুইপুরের দু'মাইল উত্তর-পশ্চিমে গোবিন্দপুর গ্রামে দ্বাদশ শতাব্দীর সেনবংশীয় রাজা লক্ষ্মণসেনের গ্রামদানের একটি তাম্রশাসন পাওয়া যায় এই গ্রামে পুরানো একটি পুকুরপাড়ে কারুকাজ করা ইটের একটি স্তুপ দেখা যায়। এখানকার সেনপাড়ায় পুকুর খননের সময় মাথায় নিখুঁত বহুগুণাবিশিষ্ট সর্পছত্রযুক্ত জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের একটি নগ্নমূর্তির সন্ধান মিলেছিল।

দক্ষিণ বারাসাতের দুই মাইল দক্ষিণে বড়ুক্ষেত্র বা বহড়ু গ্রামেও ছ'ফুট উঁচু সুন্দর একটি সূর্যমূর্তি পাওয়া গেছে, গ্রামের লোক 'পঞ্চানন' বলে এর পূজা করেন। ময়দাগ্রামে পুকুর খুঁড়তে গিয়ে প্রায় দেড়ফুট উঁচু নৃত্যরত চমৎকার একটি গণেশমূর্তি পাওয়া যায়।জয়নগর থানার মধ্যে দক্ষিণ বারাসাত গ্রামে বিষ্ণু, নৃসিংহের একাধিক পাথরের মূর্তি, বিষ্ণুচক্র, স্তম্ভ ইত্যাদি পাওয়া গেছে।জয়নগরের তিন মাইল দক্ষিণে উত্তরপাড়ার জমিদারদের একটি পুরানো কাছারিবাড়ির কাছে পুকুর সংস্কারের সময় তিনটি সুন্দর বিষ্ণুমূর্তি ও একটি দশভূজা দুর্গামূর্তি পাওয়া যায় মূর্তিগুলো জমিদাররা তাদের উত্তরপাড়া লাইব্রেরিতে নিয়ে যান৷ছত্রভোগে একটি কুবেরের মূর্তি, বিষ্ণু ও দশভূজা দুর্গামূর্তি, ব্রোঞ্জের গণেশ ও নৃসিংহমূর্তি পাওয়া গেছে।

আটঘরা থেকে তাম্রমুদ্রা, মৃৎপাত্রের টুকরো, পোড়ামাটির মেষমূর্তি, যক্ষ্মিণীমূর্তি, শীলমোহর,তৈজসপত্র, পাথরের বিষ্ণুমূর্তি ইত্যাদি মিলেছে।১৮৬০-এর দশকে মথুরাপুর থানার মধ্যে, লট নং ১১৬, পুরানো আদিগঙ্গার খাত থেকে এখানকার গভীর জঙ্গল পরিষ্কারের সময় 'জটার দেউল' নামে একটি মন্দির আবিষ্কৃত হয়। অনেকের মতে, এখানে জটাধারী নামে এক শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত ছিল আবার কারোর মতে জটাধারী বড় বড় বাঘ এখানে ঘুরে বেড়াত। ১৯২১-২২ সালে জটার দেউলের বারো-তেরো মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে জগদ্দলের  কাছে আরও একটি মন্দিরের অবশেষের হদিশ মিলেছিল।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা জুড়ে রয়েছে প্রচুর পর্যটন স্থল , যেখানে প্রতিবছর প্রচুর পর্যটক আসেন।দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সুন্দরবন জাতীয় উদ্যানকে সুন্দরবন সংক্ষিত অরণ্যের অন্তর্গত সুন্দর ব্যাঘ্র প্রকল্প-এর মূল কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।  সুন্দরবন একটি প্লাস্টিকের মুক্ত এলাকা। সুন্দরবন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। সুন্দরবন একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান ঘোষণা করা হয়েছে। সুন্দরবন ৩,৮৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ   নদী এলাকায় আচ্ছাদিত।

১৯৬৬ সাল থেকে সুন্দরবন একটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসাবে ঘোষিত হয় এবং এটি অনুমান করা হয় যে বর্তমানে ৪০০ টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং প্রায় ৩০,০০০ হরিণ রয়েছে। সুন্দরবন সুন্দরী গাছের সমৃদ্ধ বন হওয়ার কারণে বনটিকে 'সুন্দরবন' নামে অভিহিত করা হয়। সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনভূমির বনানী ক্যাম্প, কালাস আইল্যান্ড এবং সমুদ্র সৈকত, হলিডে দ্বীপ, হলিডে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ইত্যাদির  পর্যটক আকর্ষণ রয়েছে কৈখালীর কাছাকাছি।এই জেলার  সজনেখালিতে, লুথিয়ান দ্বীপে ও হ্যালিডে দ্বীপে বর্তমানে আরও তিনটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে।

এছাড়া, পাথরপ্রতিমার কাছে ভরতপুর কুমির প্রকল্প এবং সজনেখালিতে পাখিরালয় রয়েছে। ১৯৮৯ সালে সুন্দরবনের এই ভারতীয় অংশকে বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ ঘোষণা করা হয়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার দক্ষিণ প্রান্তের সমুদ্র উপকূলে ঝাউগাছের বনানীবেষ্টিত বকখালির সাগরতট ভ্রমণপিপাসুদের বরাবরই আকর্ষণীয়। এছাড়াও এই জেলায় রয়েছে মৌসুণি আইল্যান্ড , হেনরি আইল্যান্ড , এই জেলার ফ্রেজারগঞ্জএ রয়েছে বাংলার লেফট্যানেন্ট গভর্নর স্যার অ্যান্ড্রু ফ্রেজারের  বাসভবনের ধ্বংসাবশেষ সহ আরও অনেক পর্যটন স্থল।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা অন্যতম মেলা গুলি হল  গঙ্গাসাগর মেলা, জয়নগরের দোল উৎসবের মেলা, মজিলপুরের ধন্বন্তরির বেশের মেলা, বড়িশার চণ্ডীমেলা ও আছিপুরের চীনা মন্দিরের মেলা। তার দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা উল্লেখযোগ্য একটি মেলা হল গঙ্গাসাগর মেলা প্রতি বছর মকর সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে সাগর দ্বীপের দক্ষিণে গঙ্গাসাগরের কপিল মুনি মন্দিরে পূজা ও মেলা আয়োজিত হয়। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে গঙ্গাসাগরে তিন দিন স্নানের বিধি রয়েছে। এছাড়াও জয়নগরের দোল উৎসবের মেলাও খূব বিখ্যাত ।প্রতি বছর দোল পূর্ণিমায় জয়নগরে দুর্গাপুর গ্রামের আরাধ্য দেবতা শ্যামসুন্দরের মন্দিরে পক্ষকাল ব্যাপী উৎসব ও মেলা আয়োজিত হয়।