ইফতার পার্টি এখন রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ, রোজা না করলে ডাক পড়ে নেতাদের

ইফতার পার্টি এখন রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ, রোজা না করলে ডাক পড়ে নেতাদের

মলয় দে   শান্তিপুর:- সারাদিন নির্জলা উপোস থেকে করতে হয় রোজা। এরপর সন্ধ্যে নাগাদ কিছু ফল মিষ্টি মুখে দেওয়া। যার নাম ইফতার পার্টি। রমজান মাসে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের একটি মাস ধরে এই কঠোর নিয়ম পালন করতে হয়। বর্তমানে চলছে প্রচন্ড দাবদাহ। কিন্তু তা বলে তো আর ঘরে বসে থাকলে চলবে না! সংসার চালানোর তাগিদে কাজে বের হতেই হয়।

রাজমিস্ত্রির কাজ করেন জাহিরুল শেখ। প্রচণ্ড গরমে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলেও ধর্মীয় নিয়ম মেনে রোজা করার জন্য এক  ফোটা জল খাওয়ার নিয়ম নেই। যদিও রোজা পালনের পর ইফতার পার্টিতে কিছু ফল যে কিনবেন, তার উপায় কোথায়? আকাশছোঁয়া ফলের দামে  সামান্য রোজগারে ইফতার পার্টিতে জুটছে সামান্য কিছু ফল। অথচ নদীয়ার শান্তিপুর শহরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা আয়োজন করছেন ইফতার পার্টি।

হাজির হচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই প্রথা চলে আসলেও এখনো পর্যন্ত জাহিরুল শেখের ডাক আসেনি। আক্ষেপ না করে অবশ্য জাহিরুল শেখ জানালেন,' এসব ভেবে কি হবে? ওইসব জায়গায় ডাক পড়ে বড় বড় নেতারা তাদের। আমাদের মত মানুষের ডাক পড়ে না।' মাছ বিক্রি করেই সংসার চালাতে হয় ইনসান আলী দফাদার কে।

মাত্র দশ বছর বয়স থেকে তিনি রোজা পালন করে আসছেন মাছ বিক্রির হাট দিতে গিয়ে গলা চৌচির হয় তবুও সামান্য রোজগার দিয়ে কেনেন ফল। রোজা পালনের বয়স বর্তমানে ৪৭ বছর। সারাদিনের রোজার পর সন্ধের ইফতার পার্টিতে কখনো-সখনো মসজিদে ডাক পড়ে। তবে রাজনৈতিক নেতাদের ইফতার পার্টিতে আজ অবধি ডাক পাননি।

নির্জলা উপোস থেকে মাছ কাটতে কাটতে তিনি জানালেন,' কই আমাকে তো কেউ ডাকেনি আজ অবধি। আমাদের ডাকবেও না। বাজারে এখন ফলের দাম আকাশছোঁয়া। যা সামান্য আয় হয়, রোজার পর ইফতারের কিছু ফল কিনে তাই দিয়েই চালিয়ে দেই।' দিনমজুর অভিক সেখের ও একই কথা। অভিক বললেন,' কাজে তো বের হতেই হয়।

কাজের মধ্যেই রোজা পালন করি। ফল কেনা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু সামান্য কিছু ফল কিনে সন্ধ্যায় ইফতার সারি।' প্রচন্ড জল তেষ্টা পেলেও সারাদিন টোটো চালানোর সময় কঠোরভাবে নিয়ম পালন করেন টোটো চালক আখের আলী শেখ। তিনিও কোন রাজনৈতিক নেতার ইফতার পার্টিতে এখনো পর্যন্ত ডাক পাননি। তিনি জানালেন,' এখনো পর্যন্ত আমি ইফতার পার্টিতে ডাক পাইনি।'

অনেকটাই বয়স হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সংসার চালানোর তাগিদে টোটো  চালাতে হয় আলিম মন্ডলের। রাজনৈতিক নেতাদের ইফতার পার্টিতে তিনি কোনদিনই ডাক পাননি। তিনি জানালেন ইফতার পার্টি এখন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে রোজা না করলেও নেতৃস্থানীয়দের ডাক পড়ে সেখানে। যাদের সামান্য রোজগার তাদের ফল কেনার সামর্থ্য কোথায়? তবুও যতটুকু পারা যায় কেনা হয়। একজনের জন্য অন্তত ৫০ টাকার ফল কিনতে হয়।

বাড়িতে পাঁচজন রোজাদার থাকলে দৈনিক খরচ আড়াইশো টাকা। রাজনৈতিক নেতাদের ইফতার পার্টিতে বড়লোকদের ডাকা হয়।আমাদের মতো গরীবদের ডাকা হয় না। রোজা করেননি এমন অনেক মানুষ সেজেগুজে ইফতার পার্টিতে হাজির হন, এমনও দেখেছি।' মাছ বিক্রেতা আনোয়ার শেখ সামান্য রোজগার করে সারাদিন রোজার পর ইফতার সারেন।

যতটুকু পারেন সেই টাকা দিয়ে কিছু ফল কেনেন। জানালেন,' রাজনৈতিক নেতাদের ইফতার পার্টিতে আমি আজ অব্দি ডাক পাইনি।' বাড়িতে বাড়িতে জল পৌঁছে দিয়ে মানুষের জলের পিপাসা মেটান আব্দুস সালাম কারিগর। রোজা পালন করার কারণে অথচ তাকে নির্জলা থাকতে হয়। রাজনৈতিক নেতাদের ইফতার পার্টিতে ডাক না পাওয়া প্রসঙ্গে তার বক্তব্য,' ওখানে বড়লোকদের ডাক হয়।

আমাদের মতো মানুষদের ডাকা হবে কেন? আমি বাড়িতে ইফতার সারি। আগুন ছোঁয়া ফলের দাম। যতটুকু পারি তা দিয়ে কিছু ফল কিনি।' তবু মানুষের বাড়ি জল পৌঁছতে গেলেও নিজে যে এতোটুকু জল পান করতে পারেন না সে বিষয়ে তিনি বললেন,' আমি যে রোজা পালন করি। কারণ এটা আমাদের আল্লাহর হুকুম।'

পেশায় তন্তুজীবি আকবর আলী মন্ডল মনে করেন, ইফতার পার্টিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে, তার ফলে মহৎ উদ্দেশ্য হারাচ্ছে ক্রমশ। প্রকৃতপক্ষে উদার মন নিয়ে পাড়া ঘরে মসজিদে দুই-একজন ইফতারের আয়োজন করলেও রাজনৈতিক ভাবে আয়োজিত অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।