ঝাড়গ্রাম জেলা

ঝাড়গ্রাম জেলা

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মেদিনীপুর বিভাগের অন্তর্গত একটি জেলা ঝাড়গ্রাম  । পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জেলাই একে অন্যের থেকে যেমন ভূমিরূপে আলাদা, তেমনি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও স্বতন্ত্র। প্রতিটি জেলার এই নিজস্বতাই আজ আমাদের বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে।সেরকমই একটি জেলা হল ঝাড়গ্রাম( Jhargram)। এখানকার বনভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই হল এই জেলার বিশেষত্ব। কংসাবতী, সুবর্ণরেখা, দুলুং, তারাফেনি প্রভৃতি নদীর মনোরম সৌন্দর্যের সাথে এখানে মিশে রয়েছে শালবনী, হাতিরি, বেলপাহারীর অপূর্ব বন্য শোভা।

২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমাটিকে নিয়ে এই জেলাটি গঠিত হয়। এটি পশ্চিমবঙ্গের দ্বাদশতম জেলা, ঝাড়গ্রাম জেলার জেলাসদর হল ঝাড়গ্রাম শহর। ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি অন্যতম জেলা ঝাড়গ্রামের উত্তরে বাঁকুড়া জেলা, দক্ষিণে ওড়িশা রাজ্য, পূর্বে পশ্চিম মেদিনীপুর এবং পশ্চিমে ঝাড়খণ্ড রাজ্য ঘিরে রয়েছে সমগ্র জেলাটিকে।

৩০৩৭ বর্গ কিমি স্থান জুড়ে বিস্তৃত ঝাড়গ্রাম জেলা আয়তনের বিচারে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে সতেরোতম স্থানে রয়েছে৷ ২০১১ সালের আদমসুমারী অনুসারে ঝাড়গ্রামে প্রায় ১১৩৬৫৪৮ জন মানুষ বসবাস করেন। লোকসংখ্যার বিচারে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে ঝাড়গ্রাম বাইশতম স্থানে রয়েছে৷ এই জেলায় মূলত বাংলা ভাষাভাষী(৭৮.২৮%) মানুষ বসবাস করেন।

এছাড়া সাঁওতালি (১৮.৯০%), কুরমালী (১.২৫%), মুন্ডারি (১.৪৬%) ও অন্যান্য (০.১১) ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরও এখানে বাস রয়েছে৷ ঝাড়গ্রামের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় সম্রাট আকবরের হয়ে রাজা মান সিং ১৫৪৭ সালে বাংলা জয় করতে আসেন।তিনি তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি সর্বেশ্বর সিংকে স্থানীয় শাসকদের পরাজিত করার জন্য নিয়োগ করেন। এই সর্বেশ্বর সিং তাঁর সেনাবাহিনী সহ মল উপজাতিদের শাসককে পরাজিত করে নিজে মল্লদেব নাম গ্রহণ করেন এবং প্রায় ১২০০ বর্গ কিমি বিস্তৃত জঙ্গলখণ্ড অঞ্চলটির শাসনভার গ্রহণ করেন। এই জঙ্গলখণ্ড এলাকাই আজকের ঝাড়গ্রাম বলে মনে করা হয়।

সর্বেশ্বর সিং-ই হলেন ঝাড়গ্রাম সাম্রাজ্যের মূল প্রতিষ্ঠাতা। তিনি নিজেকে রাজা ঘোষণা করে তাঁর সাম্রাজ্যের রাজধানীর নাম ঝাড়গ্রাম ঘোষণা করেন। বর্তমানে ঝাড়গ্রাম ভ্রমন পিপাসু মানুষদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান৷ জঙ্গল প্রিয় মানুষেরা ভীড় করেন এই শাল মহুয়া ঘেরা জেলায়৷ ইতালীয়  স্থাপত্যশৈলির মিশ্রণে তৈরী ঐতিহ্যমন্ডিত ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

১৯৩১ সালে ৭০ বিঘে জমির উপর ঝাড়গ্রামের শেষ রাজা নরসিংহ মল্লদেব এই রাজবাড়ি তৈরি করেন। এছাড়াও প্রায় চারশো বছরেরও বেশী প্রাচীন কনক দুর্গা মন্দির, ডুলুং নদীর তীরে অবস্থিত চিল্কিগড় রাজবাড়ি, ঝাড়গ্রাম চিড়িয়াখানা, ঘাঘরা জলপ্রপাত ও তারাফেনি বাঁধ এখানকার অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র।ঝাড়গ্রাম জেলা উপজাতীয় সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। চুয়াং, চ্যাং, ছৌ, ড্যাংগ্রে, ঝুমুর, পান্তা, রণপা, সাহারুল লোকনৃত্য যেমন বিখ্যাত তেমনি টুসু পরব, বাহা পারব, করম পূজা, ভাদু উত্সব, বদনা পরব এই জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে। ঝাড়গ্রাম জেলা  ১০টি থানা, ৮টি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, ৮টি পঞ্চায়েত সমিতি, ৭৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ২,৯৯৬টি মৌজা, ২৫১৩টি গ্রাম, ১টি পুরসভা ও ১টি জনগণনা নগর নিয়ে গঠিত।

এই জেলার একমাত্র পুরসভাটি হল জেলাসদর ঝাড়গ্রাম এবং একমাত্র জনগণনা নগরটি হল শিলদা। হাওড়া / টাটানগর থেকে ঝাড়গ্রাম জেলা স্টেশনে পৌঁছাতে এক্সপ্রেস / লোকাল ট্রেন আছে ।কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রাম জেলা পৌঁছাতে একটি ট্রেনের সর্বনিম্ন সময় লাগে ২ ঘন্টা ২4 মিনিট। কলকাতা থেকে এনএইচ 6 (মুম্বাই-কলকাতা মহাসড়ক) দ্বারা ঝাড়গ্রামে পৌঁছাতে 4 ঘন্টা সময় লাগে ।

ঝাড়গ্রাম খুব ভালোভাবে মহাসড়কগুলির সাথে যুক্ত। এই জেলায় এএইচ ৪৬ অবস্থিত। এটি এশিয়ান হাইওয়ের অন্তর্গত। অন্যান শহর যেমন মেদিনীপুর (খড়গপুর-মেদিনীপুর রোডে ৪০ কিলোমিটার), খড়গপুর (এনএইচ ৪৯ তে ৪৬ কিলোমিটার), দুর্গাপুর (১৫৬ কিলোমিটার এসএইচ -৯), আসানসোল (এনএইচ -১৪ ও এসএইচ-৯ হয়ে ১৮১ কিলোমিটার),

বাঁকুড়া (এসএইচ-৯ ও ৫ হয়ে ১১৪ কিলোমিটার), পুরুলিয়া (এসএইচ -৫ হয়ে ১৪২ কিলোমিটার), হলদিয়া (১০ কিলোমিটারের বেশি। এসএইচ -৫ হয়ে ১১৪ কিলোমিটার), দীঘা (১৬৫ কি.মি. এনএইচ -৪৯, ১১৬ ও ১১৬বি হয়ে ), কলকাতা / হাওড়া (১৬৯ কি.মি. এএইচ ৪৬ হয়ে), টাটানগর (১১৪ কিলোমিটারের এনএইচ-৩৩ হয়ে), বরিপাদা (৯৯ কিলোমিটার এএইচ ৪৬ এবং এনএইচ-৪৯ হয়ে) -এর সঙ্গে সড়ক পথে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে।

অরণ্যসুন্দরী ঝাড়গ্রাম শহরের পূর্বপ্রান্তে বনভূমির মধ্যে ডিয়ার পার্ক বা জুলজিক্যাল গার্ডেন। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে সড়কপথে ৩ কিলোমিটার পথ ধরে গেলেই ডিয়ার পার্ক । সেখানে রয়েছে চিতা, হরিণ, অন্যান্য জন্তু, কৃষ্ণসার হরিণ, ময়ূর, ভাল্লুক, হায়না, বাঁদর, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ সহ বন্য প্রাণীদের দেখা যায়। ঝাড়গ্রাম থেকে ঘাগরার দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার৷ চার দিকে সবুজ শালের সমারোহ৷ বেলপাহাড়ির ঘাগরা জলপ্রপাত।

ঝাড়গ্রাম বা বেলপাহাড়ি থেকেও গাড়ি ভাড়া করে ঘাগরা যাওয়া যায়৷ পাহাড়ের গা বয়ে জলের স্রোত। কাচের মতো পরিষ্কার দেখতে জল। তবে একটু সাবধানে থাকতে হয়, পাহাড়ের খাঁজ রয়েছে। ঝাড়গ্রাম শহরে রাজবাড়ির গৌরবময় ইতিহাস এবং দৃষ্টিনন্দন সোন্দর্য এখনও বিরাজমান। সর্বেশ্বর সিংহ এই রাজবংশের সূচক। রাজবাড়ি ঘুরে দেখার পাশাপাশি থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে।

বাগানে রয়েছে একাধিক ফল ও ফুলের গাছ। ‘সন্ন্যাসী রাজা’, ‘টিনটোরেটোর যিশু’, ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’ সহ একাধিক বাংলা ছবির শ্যুটিং হয়েছে। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে কিছু দূরে রয়েছে সাবিত্রী মন্দির। ১ কিমি দূরে দৃষ্টিনন্দন শাল জঙ্গলে লোক ও আদিবাসী সংস্কৃতি উপাদান নিয়ে বাঁদরভুলা সংগ্রহশালা । পাশাপাশি পর্যটকদের থাকার জন্য ৪-৫ টি রিসর্ট রয়েছে। এখানে একটি মুক্ত মঞ্চ রয়েছে। রাত্রি বাস করা যায় সেখানে। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে সড়কপথে বেলপাহাড়ি ৩৭ কিলোমিটার।

বেলপাহাড়ি থেকে সড়কপথে ২৫ কিলোমিটার কাঁকড়াঝোড়। বেলপাহাড়ি অঞ্চলে পাহাড় বিরাজমান। রয়েছে কাঁকড়াঝোড় অরণ্য। মনোরম পরিবেশ, রাস্তায় ময়ূরের দেখা মিলতে পারে। আমলাশোল পাহাড় রয়েছে। ভ্রমণপ্রিয়দের জন্য এই জায়গাটি আদর্শ। বাংলা ছবি চার মূর্তির শ্যুটিং হয়েছিল। বেলপাহাড়ি থেকে সড়কপথে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে জঙ্গলের মাঝে গাডরাসিণী পাহাড়।

অরণ্যে ঘেরা এই পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত গাডরাসিণী আশ্রম। লাহিড়ী মহারাজ ও স্বামী যোগানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এই আশ্রম বহু মানুষ তাঁদের আধ্যাতিকতার দর্শন করেন। গাডরাসিণী পাহাড়ে প্রচুর রং-বেরঙের পরিযায়ী পাখি আসে। বেলপাহাড়ি থেকে সড়কপথে ২০ কিলোমিটার দূরে লালজল পাহাড়। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চড়াই-উতরাই রাস্তা অতিক্রম করে পাহাড়ি পথে লাল জল পাওয়া যায়।

ওই এলাকায় এই সময় খেজুরের গুড় পাওয়া যায়। পাহাড়ের উপরে উঠলে জঙ্গলের অনেকটাই অংশ দেখা যায়। বেলপাহাড়ি থেকে সড়কপথে প্রায় ১১ কিলোমিটার জঙ্গলের পথ। তিনটি পাহাড় ঘেরা মুগ্ধ করা হ্রদ খ্যাঁদারানি। সুবিশাল হ্রদে পরিযায়ী পাখিদের মেলা । দক্ষিণে সুউচ্চ গাড়রাসিণী, পশ্চিমে সিংলহর পাহাড়, মাঝে দিগন্ত বিস্ত্রত জলাশয়ে পাখির ঝাঁক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দিয়ে চলেছে খ্যাঁদারাণী।

ঝাড়গ্রাম থেকে প্রায় ১৪ কিমি দূরে চিল্কিগড়ের কনক দুর্গা মন্দির। বিভিন্ন ওষুধি গাছের সমারোহ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা দেয়। মন্দিরটি ডুলুং নামে একটি ছোট নদীর পাশে ঘন জঙ্গলে অবস্থিত। বেশ কিছু বিরল প্রজাতির গাছ, পাখি এবং বানর এখানে দেখা যায়। কনক দুর্গার পথে কেন্দুয়া নামে একটি স্থান আছে। শীতকালে পরিযায়ী পাখিরা এই স্থানে আসে।

চিল্কিগড়ে রয়েছে রাজবাড়ি। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে সড়কপথে গোপীবল্লভপুর ৪২ কিমি। সুবর্ণরেখা নদীর তীরে অবস্থিত একটি সুন্দর পার্ক। সুবর্ণরেখা নদীর সঙ্গে এটি একটি ভাল প্রকৃতিকে সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। গোপীবল্লভপুর থেকে সড়কপথে ২২ কিলোমিটার ঝিল্লির পাখিরালয় ।

এটি হাতিবাড়ি কটেজ থেকে ১০ কিমি দূরে। সূর্য দয়ের সময় সূর্যের মৃদু আলোতে জায়গাটি পরিদর্শন করেন তবে আপনাকে স্বাগত জানানোর জন্য হ্রদে এক ঝাঁক পরিযায়ী পাখির কিচিরমিচির অপেক্ষা করবে। সবুজের গালিচার মাঝে পাবেন এক বিশাল জলাধার।

রাত্রিবাস জন্য রয়েছে কটেজ।রাত্রি বাসের জন্য রয়েছে রাজবাড়ীর কটেজ, বাঁদর ভুলা গেষ্ট হাউস, বেলপাহাড়ি এলাকায় রয়েছে হোম স্টে। তা ছাড়া রয়েছে একাধিক হোটেল ও অতিথি নিবাস। তবে এই মরসুমে পর্যটকের ভিড় বেশি থাকায় আগে থেকেই বুকিং করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের ওয়েবসাইট থেকে বুকিং করতে হয় সরকারি আবাসনগুলির জন্য। তা ছাড়া ফরেস্টের বাংলো একই ভাবে বুকিং করতে হয়।

কী করে যাবেন কলকাতা থেকে প্রায় ১৭০ কিমি দূরে ঝাড়গ্রাম। জাতীয় সড়ক ধরে লোধাশুলি হয়ে ঝাড়গ্রামে যাওয়া যায়। আবার খড়গপুর এর চৌরঙ্গী থেকে মেদিনীপুর শহর হয়ে ধেরুয়া হয়ে সহজে যাওয়া যায় ঝাড়গ্রামে। হাওড়া থেকে ঝাড়গ্রাম যেতে ট্রেনে সময় লাগে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা৷ তা ছাড়া সড়ক (জাতীয় সড়ক ৬ (মুম্বাই-কলকাতা জাতীয় সড়ক) পথে প্রায় চার ঘণ্টা সময় লাগে।