রায়গঞ্জ | Raiganj

রায়গঞ্জ | Raiganj

রায়গঞ্জ Raiganj কুলিক নদীর তীরে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলার ২০০ বছরের প্রাচীন শহর  Raiganj রায়গঞ্জ। উত্তর দিনাজপুর জেলার সদর দপ্তর রায়গঞ্জ এবং একইসঙ্গে এটি একটি পৌরসভা এলাকা। ভৌগোলিক অবস্থানের বিচারে রায়গঞ্জ ২৫.৬২০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.১২০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত।

সমুদ্রতল থেকে এই জনপদের উচ্চতা মোটামুটিভাবে ৪০ মিটার। ৩৬.৫১ বর্গকিমি. জায়গা জুড়ে বিস্তৃত রায়গঞ্জের চারপাশে রয়েছে পীরগঞ্জ, বিড়োল, গঙ্গারামপুর, কাটিহার, হরিপুর, পূর্ণিয়া, মণিহারি ইত্যাদি উত্তর দিনাজপুর জেলার অন্যতম শহরগুলি।

বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছে রায়গঞ্জ অবস্থিত। রায়গঞ্জ সদর শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে কুলিক নদী। তার পাশেই গড়ে উঠেছে বিখ্যাত কুলিক পাখিরালয়। এই জনপদের নামকরণ কীভাবে রায়গঞ্জ হল সে সম্পর্কে বিশেষ কোনো ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ নেই।

অনেকে মনে করেন দিনাজপুরের রাজবংশের পদবী ছিল রাই আর সেখান থেকেই হয়তো এই জনপদের নাম হয়েছে রায়গঞ্জ। বহু প্রাচীনকাল থেকে এই বিশেষ অঞ্চল রাই সরিষার উৎপাদনের জন্য খুবই বিখ্যাত ছিল। বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন যে এই রাই সরিষার ‘রাই’ কথাটি থেকেই এই জনপদের নামকরণ হয়েছে। এই রাই সরিষা এক বিশেষ প্রকারের তৈলবীজ।

অনেকে আবার রায়গঞ্জের ‘রাই’ কথার মধ্যে কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি রাধার অনুষঙ্গ খুঁজে পান। প্রাচীনকালে রায়গঞ্জের অন্যতম উৎসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তুলসিবিহার উৎসব। জৈষ্ঠ্য মাসে অনুষ্ঠিত এই উৎসবে রায়গঞ্জের অগণিত নারী তুলসি গাছকে শ্রীজ্ঞানে পূজা করে তার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতেন। ধ্যানে ও জপের মধ্য দিয়ে নিজেদের স্বামী হিসেবে ‘রাই’ বেশে তারা সকলে শ্রীকৃষ্ণের পূজা করতেন।

‘রাই’-এর অর্থ রাধিকা। এই ‘রাই’ থেকেই হয়তো রায়গঞ্জ নামের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। এই অনুষঙ্গ থেকে অনেকে অনুমান করেন রায়গঞ্জের নিকটবর্তী শহর কালিয়াগঞ্জের নামের মধ্যে ‘কালিয়া’ বলতে আসলে কৃষ্ণকে বোঝানো হয়েছে। প্রাচীনকালে নগর ও কুলিক নদী বয়ে যেত এই জনপদের বুক চিরে আর এই দুই নদীর পলিবাহিত হয়ে সমগ্র রায়গঞ্জ অঞ্চলে তৈরি হয়েছিল বরেন্দ্রভূমি।

ধার্মিকেরা মনে করেন ইন্দ্রের আশীর্বাদ ধন্য এই অঞ্চলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেন ও পাল রাজাদের অনেক স্মৃতি। প্রাচীনকালে এখানকার নগর ও কুলিক নদীর ধারে তিন রাত উপবাসে কাটালে নাকি অশ্বমেধ যজ্ঞের মতো ফল পাওয়া যায়, একথা বহু প্রাচীনকালের মানুষদের জনশ্রুতিতে রয়েছে। ধার্মিকদের বিশ্বাস যে শিব ও পার্বতীর বিয়ের সময় শিবের হাতে ঢেলে দেওয়া জল অজস্র ধারায় ছড়িয়ে পড়েছিল যার মধ্যে দুটি ধারা থেকে তৈরি হয়েছিল এই নগর ও কুলিক নদী।

শিব পুরাণ ও পার্বতী পুরাণে বলা আছে যে, কুলিক ও নগর নদীর জল এতটাই পুণ্যঋদ্ধ যে মৃত্যুর পরে কারো অস্থি এই দুই নদীতে ভাসালে তার স্বর্গলাভ হয়। ইন্দ্রের প্রভাব ও আশীর্বাদ যতদিন এই নদীর উপর রয়েছে, ততদিন এই নদী দুটিকে স্বর্গলোকের দ্বার বলে মনে করা হবে। প্রাচীন পুঁথিপত্রে এই দুটি নদীর নাম রয়েছে কুল্লিক ও নাগর হিসেবে। অনেকে মনে করেন, এই দুটি নদীর কোনো একটির তীর ধরেই ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বাংলা আক্রমণে উদ্যত হয়েছিলেন।

কিন্তু এই তথ্যের কোনো সত্যতা যাচাই করা যায়নি। ১৬০৮ থেকে ১৬৩০ সালের মধ্যে বাংলার বারো ভুঁইয়াদের দমন করার জন্য মোগল সম্রাট কুলিকের বন্দর ঘাট ব্যবহার করেছিলেন বলে জানা যায়। দিনাজপুরের রাজা রামনাথ রায়ের আমলে রায়গঞ্জে গড়ে ওঠে রাজস্ব আদায়ের একটি কাছারিবাড়ি। প্রাচীনকালে এখানকার ধান, তুলাইপাঞ্জি চাল ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ও ভারতের বাইরে ইউরোপেও রপ্তানি হতো। রায়গঞ্জের চটের ধোকড়া রপ্তানি হতো সুদূর চিনের বাজারে।

রায়গঞ্জের কর্ণঝুরা অঞ্চলকে কেন্দ্র করে একটি জনশ্রুতি আছে। লোকের বিশ্বাস সত্য যুগে এখানে এসেছিলেন দাতা কর্ণ এবং মায়ের চিন্তায় ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি। রায়গঞ্জের ইতিহাস নিহিত আছে দিনাজপুরের প্রাচীন ইতিহাসের মধ্যে। সতেরো শতকের শেষ দিকে রাজা রামনাথ এই রায়গঞ্জের বিন্দোলে একটি ভৈরবের মন্দির স্থাপন করেছিলেন।

সেই সময় দিনাজপুরের জমিদারির ভার ছিল তাঁরই হাতে। বাংলার টেরাকোটা অলংকরণ সমৃদ্ধ প্রাচীন মন্দির স্থাপত্যগুলির মধ্যে অন্যতম এই বিন্দোলের ভৈরব মন্দির। বিন্দোলের মার্তণ্ড ভৈরবের মন্দিরে এক সময় নাকি শ্রীকৃষ্ণ ঘন তমাল পাতার আড়ালে গোপিনীদের উদ্দেশ্যে বাঁশি বাজাতেন। প্রতি বছর রাসপূর্ণিমা উপলক্ষে এখানে বিশাল মেলা বসতো।

রায়গঞ্জ বন্দরের করুণাময়ী কালী মন্দির স্থাপিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে। আগে এই জনপদের কুলিক নদীর পাশেই ছিল বিখ্যাত নদী বন্দর যেখানে বাণিজ্য করতে আসা বণিক, সওদাগরেরা এই কালী মন্দিরের বেদিতে পুজো দিয়ে বাণিজ্য শুরু করতেন বলে জানা যায়।

জনশ্রুতি আছে যে, দিনাজপুরে সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের অন্যতম নেতা রঘুনন্দন গিরি গোঁসাই এক পাঞ্জাবী সাধুর বেশে এই মন্দিরে এসে একটি পঞ্চমুণ্ডির আসন স্থাপন করেন। ১৮৯০ সালে এই মন্দিরের সংস্কার করা হয় দিনাজপুর রাজ এস্টেটের দাক্ষিণ্যে এবং আরো পরে ১৯৩০-৪০ সাল নাগাদ রায়গঞ্জের মানুষদের অনুদানের অর্থে বেনারস থেকে কালী মূর্তি নিয়ে আসা হয় এই মন্দিরে।

১৮৮৬ সালে হেমতাবাদ থানার কিছু অংশ কেটে নিয়ে পৃথকভাবে গড়ে ওঠে রায়গঞ্জ থানা। স্বাধীনতার আগে এই থানার অধীনে মোট ২৪২টি গ্রাম ছিল বলে জানা যায়। এই থানার অধীনে সে সময় ৬৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠে এবং ১৯১১ সালে রায়গঞ্জ সদর শহরে ৪৯৩ জন ছাত্র নিয়ে গড়ে ওঠে রায়গঞ্জ করোনেশন হাই ইংলিশ স্কুল। রায়গঞ্জের মোহনবাটি, কৃষ্ণমুরি, কানাইপুর, পশ্চিম গোবিন্দপুর ইত্যাদি অঞ্চলগুলি মহাভারতের নানা কাহিনী সমৃদ্ধ। এ সবই এখানকার মানুষদের মননজাত।

দেশ বিভাগের ফলে ১৯৪৮ সালের ১৪ জুলাই রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, হেমতাবাদ, ইটাহার ও কুশমণ্ডিকে নিয়ে একত্রে গড়ে উঠেছিল রায়গঞ্জ মহকুমা। রাজ্য শিক্ষা পর্ষদ, আইএসই, সিবিএসই বোর্ডের বিভিন্ন স্কুল রয়েছে এখানে যার মধ্যে কিছু বাংলা মাধ্যম স্কুলও রয়েছে। এখানকার সবথেকে প্রাচীন স্কুল হল রায়গঞ্জ করোনেশন হাই ইংলিশ স্কুল এবং সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল।

রাজ্যের অধীনে রায়গঞ্জে গড়ে উঠেছে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এখানকার রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয় অন্যতম উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও দুর্গাপূজা ও কালীপূজা বেশ ধুমধাম করে অনুষ্ঠিত হয়। রায়গঞ্জের নেতাজি পাঠাগারের কালীপূজা, বন্দর কালীবাড়ির কালীপূজা এবং সুদর্শনপুরের দুর্গাপূজা খুবই বিখ্যাত।

অনেকে মনে করেন এই বন্দর কালীবাড়ির প্রধান পুরোহিত নাকি সাধক বামাক্ষ্যাপার বংশধর। এছাড়া প্রাচীনকালে তুলসিবিহার উৎসবের প্রাধান্য থাকলেও এখন সেই প্রথা বা রীতি অবলুপ্ত হয়ে গেছে। উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে রায়গঞ্জে খান নাচ, নাটুয়া, মোখা নাচ, জং গান, হালনা হালনানি নাচ, ভোগতা নাচ খুব বিখ্যাত। তাছাড়া এখানকার টেরাকোটা ও পাটের বা চটের তৈরি নানা হস্তশিল্পের বেশ কদর রয়েছে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে।

রায়গঞ্জ কিসের জন্য বিখ্যাত   রায়গঞ্জ ভারতের মধ্যে একমাত্র স্থান যা তুলাইপাঞ্জি বাসমতি চাল উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এই বিশেষ প্রকারের চাল গন্ধ ও স্বাদের জন্য খুবই বিখ্যাত। জানা যায়, এই চাল রায়গঞ্জ থেকে লণ্ডন অলিম্পিকেও পাঠানো হয়েছিল ভারতের পক্ষ থেকে। এছাড়া এক বিশেষ প্রকারের বেগুন এখানে উৎপাদিত হয় যা আকারে বেশ বড়ো এবং স্বাদেও তুলনাহীন।

রায়গঞ্জের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় রায়গঞ্জ বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য তথা কুলিক পাখিরালয়ের কথা। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম পাখিরালয় হিসেবে বিখ্যাত এই কুলিক পাখিরালয়। প্রায় আশি হাজার পরিযায়ী পাখি এখানে আসা-যাওয়া করে যাদের মধ্যে এশীয় শামুকখোল অন্যতম। পরিসংখ্যানের হিসেবে দেখা যায় ১৬৪ প্রজাতির পাখি আসে এই কুলিক পাখিরালয়ে।

সামাজিক বনসৃজন প্রকল্পে এই পাখিরালয়ে লাগানো হয়েছিল জারুল, শিশু, ইউক্যালিপটাস, কদম ইত্যাদি নানা প্রজাতির গাছ। এছাড়া দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে রায়গঞ্জ গির্জা, জৈন মন্দির, বিন্দোলের ভৈরবের মন্দির, বুরহানা ফকিরের মসজিদ, বন্দর কালীবাড়ি, মহারাজা হাটের সোনি মন্দির ইত্যাদি। রায়গঞ্জ বলতে কুলিক পাখিরালয়ের কথাই প্রথম মনে আসে, এই পক্ষীনিবাসটিই এখানকার খ্যাতির কারণ। এখানে ঘুরতে এসে অনেকেই রায়গঞ্জের এদিক সেদিক ঘুরে নেন চট করে।

২০১১ সালের আদমশুমারী রায়গঞ্জ নগরবাসীর সংখ্যা ছিল ১,৯৯,৭৫৮ জন, যার মধ্যে ১,০৪,৯৬৬ পুরুষ ছিল এবং ৯৪,৭৯২ জন নারী ছিলেন। ০-৬ বছর বয়সী নগরবাসীর সংখ্যা ২২,০২৮ জন। ৭+ বছর বয়সী জনসংখ্যার জন্য কার্যকর সাক্ষরতার হার ছিল ৮১.৭১%। ভারতের ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে রায়গঞ্জ শহরের জনসংখ্যা হল ১৬৫,২২২ জন।

এর মধ্যে পুরুষ ৫৩%, এবং নারী ৪৭%। এখানে সাক্ষরতার হার ৭৫%, । পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৭৯%, এবং নারীদের মধ্যে এই হার ৭১%। সারা ভারতের সাক্ষরতার হার ৫৯.৫%, তার চাইতে রায়গঞ্জ এর সাক্ষরতার হার বেশি। এই শহরের জনসংখ্যার ১১% হল ৬ বছর বা তার কম বয়সী। ধর্ম শতাংশ হিন্দু ৯৭.৩৭% মুসলিম ২.১৬% জৈন ০.১৬% অন্যান্য† ০.৩১% ধর্মের বিন্যাস †খ্রিস্টান (০.১৩%), শিখ (০.০২%), বৌদ্ধ (০.০৫%) অন্তর্ভুক্ত।

আনন্দবিহার-রাধিকাপুর সুপারফ্রাস্ট এক্সপ্রেস একটি দৈনিক ট্রেন, যা রায়গঞ্জকে দিল্লির সাথে সংযুক্ত করে। কলকাতা-রাধিকাপুর এক্সপ্রেস একটি প্রতিদিনের ট্রেন যা রায়গঞ্জকে কলকাতার সাথে যুক্ত করে। নতুন জলপাইগুড়ি-রাধিকাপুর প্রতিদিনের ডেমু যাত্রী যাত্রী ট্রেন শিলিগুড়ির সঙ্গে রায়গঞ্জকে যুক্ত করে।