মুর্শিদাবাদ জেলার অত্যন্ত প্রাচীন গ্রাম সোনারুন্দি

মুর্শিদাবাদ জেলার অত্যন্ত প্রাচীন গ্রাম সোনারুন্দি

মুর্শিদাবাদ জেলার  Murshidabad district কান্দি Kandi মহকুমার একদম দক্ষিণ প্রান্তের একটি গ্রাম যার নাম Sonarundi সোনারুন্দি। এই সোনারুন্দি গ্রামটি অত্যন্ত প্রাচীন। আজ থেকে প্রায় সারে আটশো বছর আগের কথা তৎকালীন সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেন বাসুদেব নামক এক মুখুটি বংশীয় ব্রাহ্মণকে বল্লিহিটা নামে একটি গ্রাম দান করেছিলেন যার বর্তমান নাম বালুটিয়া। সেই দানপত্র উদ্ধারণপুরের কাছে নৈহাটি নামে একটি গ্রামে আবিষ্কৃত হওয়ার দরুন তাকে নৈহাটি তাম্রশাসন বলা হতো।

এই বালুটিয়া গ্রাম বর্তমান আজিমগঞ্জ-কাটোয়া রেলপথের গঙ্গাটিকুরী রেল স্টেশনের ঠিক পশ্চিম দিকেই অবস্থিত। ওই তাম্রশাসনে গ্রামের এলাকা বর্ণনার মাধ্যমে এই সোনারুন্দি এলাকার অনেকটা পরিচয় পাওয়া যায়। বালুটিয়া গ্রাম থেকে দু কিলোমিটার পশ্চিমদিকে অবস্থিত বর্তমান এই সোনারুন্দি গ্রাম। ওই তাম্রশাসনে এই এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রামেরও প্রাচীন নাম আছে।

যেমন জলসথি ,মোলাদণ্ডী যার বর্তমান নাম মুরুন্দি, খাণ্ডয়িল্লা যার বর্তমান নাম খাঁড়ুলে ইত্যাদি, এই গ্রামের সংলগ্ন লোহারুন্দি ও সোনারুন্দি গ্রামের সেই সময়ের নাম ছিল লৌহদণ্ডী ও স্বর্ণদণ্ডী। প্রাচীন বাংলায় ‘দণ্ডী’ ছিল বণিকদের উপাধী। ‘দণ্ডী’ উপাধীর বণিকেরা এই এলাকায় বসবাস করতেন ও তাঁদের তামা, লোহা ও সোনার ব্যবসা ছিল বলে নিজেদের উপাধী অনুসারে এই গ্রামগুলির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

এই এলাকাটিকে বনওয়ারীবাদ ও বলা হয়ে থাকে। তাঁর কারন এখানকার রাজাদের গৃহবিগ্রহ বনওয়ারীদেবের নাম থেকে। বনওয়ারীবাদ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতার নাম ছিল নিত্যানন্দ দালাল। তাঁরা জাতিতে ছিলেন তাঁতি। এই এলাকায় এখনও তন্তুবায় বা তাঁতীদের বাস বেশি। নিত্যানন্দের বাবা জগমোহন দালাল সোনারুন্দি গ্রামে বাস করতেন। ১৭৫০ খৃষ্টাব্দে সোনারুন্দিতে নিত্যানন্দের জন্ম।

তিনি আরবী, পারসী ও উদ্দু ভাষায় খুব পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। অল্প বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে বৃন্দাবনে চলে যান।  সেখান থেকে তিনি দিল্লির বাদশাহের দরবারে চাকরি জোগাড় করেন। অসাধারণ মেধা ও ফারসি ভাষায় দক্ষতার জন্যে সেই সময়ের মুঘল বাদশা দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্টতা হয়।কালক্রমে বাদশাহ সাহ আলম নিত্যানন্দের পারসী লেখাপড়ায় খুশী হয়ে তাঁকে নিজের কাছে রাখেন এবং রাজধানী দিল্লীতে নিয়ে গিয়ে নিত্যানন্দকে নিজের মীরমুন্সী পদে নিযুক্ত করেন। সম্রাট তাঁকে দানেশবন্দ উপাধি দিয়েছিলেন।

তারপর শাহআলম তাঁকে মহারাজা উপাধি দিয়ে সাতহাজারী মনসবদার পদে নিইয়োগ করেন। তখন নিত্যানন্দের নাম হয় মহারাজা নিত্যানন্দ দানেশবন্দ আমীর উল-মুল্ক, আজমাত-উদ্দৌলা, সাফদার জং। দিল্লির রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে এবং মারাঠা আক্রমণে এক সময় বাদশা শাহ আলম দিল্লি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি এসে আশ্রয় নেন বর্ধমান রাজের এলাকা কাটোয়াতে।

সেই সময়ে নিত্যানন্দ শাহ আলমের সুপারিশে এই সোনারুন্দি এলাকার জমিদারী লাভ করেন। ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাহ আলম কাটোয়াতে ছিলেন। সেই সময়ে এই সোনারুন্দি এলাকারও রাজা বা পত্তনিদার ছিল বর্ধমানের রাজারা। সম্ভবত শাহ আলম বর্ধমানের রাজার সঙ্গে যোগাযোগ করেই নিত্যানন্দকে এই জমিদারি পাইয়ে দিয়েছিলেন।নিত্যানন্দ দেব বাহাদুর সোনারুন্দি গ্রামের পূর্ব প্রান্তে প্রায় চুয়ান্ন বিঘা জমির ওপর তার রাজবাড়ি ও মন্দির নির্মাণ করেন (১৮০৮ খ্রি)। এলাকাটি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘিরে চারদিকে চারটি বিশাল তোরণ নির্মান করলেন।

নিত্যানন্দের তিন ছেলে – ১) জগদীন্দ্র বনয়ারি লাল বাহাদুর ২) জগদীন্দ্র বনয়ারি গোবিন্দ দেব বাহাদুর ৩) আজমদৌল্লা বনয়ারি কিশোর বাহাদুর। এরা প্রত্যেকেই মুঘল বাদশার দেওয়া উপয়াধি ব্যবহার করত। বড় ছেলে লাল বাহাদুর ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের বেশ কয়েক বছর আগে মেজো ভাইকে সম্পত্তির সত্ত্ব আরোপ করে বৃন্দাবনবাসী হয়েছিলেন। ছোট ভাই কিশোর ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের আগেই দেহত্যাগ করেন। তাঁর অবিরা স্ত্রী জীবিত ছিলেন। তিনিও মৃত্যুর আগে মেজো দাদা গোবিন্দকে তার সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান।

ফলে তাদের সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয় মেজো রাজকুমার গোবিন্দ দেব বাহাদুর। মুল রাজবাড়ির সংলগ্ন পশ্চিম অংশে কিশোরী বনয়ারিলালের মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাধাকৃষ্ণ ও অষ্টসখীর মূর্তি। বৃন্দাবনের অনুসরণে তিনি এই সখীসহ যুগল মূর্তির নাম দেন কিশোরী বনয়ারিলালজি। তার চারদিকে দালান, মাঝে নাট মন্দির। লাল বেলে পাথর দিয়ে মন্দিরের সামনের দেওয়াল সাজিয়ে তুললেন। মুল প্রাসাদে একশোর বেশি ঘর ছিল। মন্দিরের পাশেই কিশোরী-সায়র পুকুর কেটে তার ঘাটে স্নানঘর ও পাশেই গোপেশ্বর শিব মন্দির নির্মাণ করলেন।

নজর-বাগানে সুদৃশ্য ফুলের ও সুস্বাদু ফলের বাগান করলেন। রাজবাড়ির বাইরে বারোটি কুঞ্জ নির্মাণ করলেন। যেখানে রাস বা ঝুলনের সময় কিশোরী বনয়ারীলালজি যেতে পারেন। মুল অনুষ্ঠানগুলিতে এই দেবমূর্তিগুলিকে নিয়ে যাওয়া হত এই জায়গাগুলিতে। মূল রাজবাড়ির এলাকার বাইরে সোনারুন্দির পূর্ব প্রান্তে ছড়িয়ে ছিল এই কুঞ্জগুলি। প্রত্যেক কুঞ্জে একটি মন্দির, সংলগ্ন পুকুরে বাঁধাঘাট নির্মাণ করেছিলেন তিনি। মূলত তিনি এই বঙ্গদেশে দ্বিতীয় বৃন্দাবন নির্মাণ করেছিলেন।

সুসজ্জিত, সুরম্য এই চত্বরকে সকলে বনয়ারীবাদ বলত। সোনারুন্দি থেকে উদ্ধারণপুর পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন।  পাশে পুকুর কাটিয়ে দিয়েছিলেন সাধারণের ব্যবহারের জন্যে। সেই সময়ে সোনারুন্দি, মুরুন্দি, খাঁড়ুলে, উদ্ধারণপুরে তার জমি ছিল প্রায় চার হাজার বিঘা। আর রাজশাহী, দিনাজপুর (বর্তমান বাংলাদেশ) ও বীরভূমের ময়ুরেশ্বরের কাছেও তাঁর জমিদারী ছিল। বনওয়ারীবাদের প্রথম মহারাজা নিজের গুণে বড় হয়েছিলেন এবং নিজের গ্রামে জনসাধারণের জন্যে মন্দির, ধর্মশালা, বিদ্যালয় প্রভৃতি নির্মাণ করিয়েছিলেন।

১৮২১ সালে তিনি পরলোক গমন করেন। মহারাজা দানেশবন্দের মৃত্যুর পরে তাঁর বড় ছেলে জগদীন্দ্র বনওয়ারীলাল মহারাজা বাহাদুর উপাধি পান। মহারাজা জগদীন্দ্র বনওয়ারীলাল ব্রহ্মযুদ্ধের সময় ইংরেজ কোম্পানীকে তিন লাখ টাকা দিয়েছিলেন এবং কলকাতার স্ট্রান্ড রোড নির্মাণের জন্যেও মহারাজা পঞ্চাশ হাজার টাকা দান করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছোট ভাই জগদীন্দ্র বনওয়ারী গোবিন্দ লর্ড ক্যানিং -এর কাছ থেকে মহারাজা উপাধি পেয়েছিলেন। তাদের পর থেকেই বনওয়ারীবাদের রাজ বংশের পতন আরম্ভ হয়।

গৃহদেবতা বনওয়ারীদেবের নামে প্রাচীন সোনারুন্দির নাম হয় বনওয়ারীবাদ। রাজবংশের সকলের নামের সঙ্গে বনওয়ারী কথাটা দেখতে পাওয়া যায়। বনওয়ারীলাল, কেউ বনওয়ারীকিশোর, কেউ বা বনওয়ারীমুকুন্দ নাম নিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার থেকে কেউ আর রাজা মহারাজা খেতাব পাননি। ঠাকুরবাড়ীর লাগোয়া এই বড় দীঘিতে বহুকাল থেকে রুই, মৃগেল, কাতলা প্রভৃতি মাছ পোষা হয়। যদি কখনও কোনও মাছ মরে ভেসে উঠে, তা হলে সেই মাছ তুলে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় ফেলা হয়।

সোনারুন্দি বনওয়ারীবাদের রাজবাড়ীর পুকুরে মাছ দেখতে এখনও অনেক লোকে আসে। এক সময় নাকি এখানে সোনার নথ পড়া মাছের দেখা মিলত।  এখানে এ মাছ নাকি কেউ ছাড়েনি, কেউ ধরেও না। লোকমুখে নানা গল্প শোনা যায়— কোনও এক সময় কেউ এক জন মাছ ধরতে গিয়েছিল। তার পর মুখে রক্ত উঠে মারা যায় সে।

দর্শনার্থীদের দেওয়া বিস্কুট ও মুড়ি খেয়ে তারা রীতিমতো নধর হয়েছে। আপনি ভয় না পেলে, তারা দিব্য আপনার হাত থেকে বিস্কুট খেয়ে যাবে। নিত্যানন্দের তিন ছেলেই নিঃসন্তান ছিলেন। ফলে গোবিন্দ দেব স্থানীয় এক আত্মীয় রাজবল্লভকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। দত্তকের পরে তার নাম হয় আনন্দ দেব। এদের কুল উপাধি ছিল নন্দী।

কিন্তু আনন্দ মদ্যপান, নারী আসক্তি প্রভৃতি কারণে অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যায়। ইনিই রাজবাড়ির পূর্বে বাইজিবাগান প্রতিষ্ঠা করেন। আনন্দের ছেলে মুকুন্দ দাস নন্দীকে মেজো রাজপুত্র গোবিন্দ তার মৃত্যুর পরে উত্তরাধিকার সেবায়েত নিযুক্ত করে সমস্ত সম্পত্তি দেবত্র করে দেন। অসাধারণ সম্ভাবনা পূর্ণ একটি পর্যটন কেন্দ্রটি আজ ধ্বংস হতে চলেছে । রাজবাড়ীর প্রথম বা মুল ফটক গেটের করুণ অবস্থা।

চারিদিকে আবর্জনা স্তুপ ও মাথার উপর জংলা গাছের আবরনে ভগ্নাবস্থায় পড়ে আছে গেটটি তারই মাঝে বসেছে বাজার ,বসেছে মাংস বিক্রীর দোকান। রাজ বাড়ি ভেঙে পড়েছে, কুঞ্জ গুলি ধ্বংস, মন্দিরের অবস্থাও ভালো না। নজর বাগান এখন অবহেলিত । চারটি অসাধারণ তোরণের দুটি সম্পূর্ণ ধ্বংস। বাকি দুটিও প্রায় শেষ। সরকার যদি এই দিকে কিঞ্চিত নজর দেয় তাহলে এটিও একটি অসাধারণ পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে।